ভাগনারপ্রধানের জন্য কী অপেক্ষা করছে

রুশ প্রেসিডেন্টে ভ্লাদিমির পুতিন ও ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ফাইল ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের কাছ থেকে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। এর ঠিক আগে আগে ২০১৩ সালে গোপন একটি দায়িত্ব পালন করছিলেন আলেকসান্দ্রা গারমাঝাপোভা। পেশায় তিনি ছিলেন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তাঁর গোপন কাজটি ছিল ক্রেমলিনের পক্ষে মতামত লেখা।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্মস্থান সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের একটি অফিসে বসে শত শত এমন মতামত লিখেছিলেন গারমাঝাপোভা। অভিযোগ রয়েছে, ওই অফিস ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের। সে সময়ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর।

আলেকসান্দ্রা গারমাঝাপোভা এখন রাশিয়ায় থাকেন না। রাশিয়ার সেনাবাহিনী নিয়ে ‘ভুয়া খবর’ প্রচারের অভিযোগ ওঠার পর গত বছর জার্মানির রাজধানী বার্লিনে পালিয়ে যান তিনি। গত শনিবার ভাগনারের বিদ্রোহের ঘটনার পর প্রিগোশিনকে ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়া একজন মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করলেন গারমাঝাপোভা। তিনি বললেন, ‘প্রিগোশিন আর বেশি দিন বাঁচার সুযোগ পাবেন না। পুতিন একজন প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ। তিনি এটা ভুলে যাবেন না যে (ভাগনারের বিদ্রোহের কারণে) তাঁকে সারা বিশ্বের সামনে অপমানিত হতে হয়েছে।’

বিদ্রোহের পর রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্ব উৎখাতে মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন প্রিগোশিন। পরে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় তা বন্ধ করেন। এরপর প্রিগোশনির ও ভাগনারের যোদ্ধারের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন পুতিন। তাঁদের বেলারুশে যাওয়ারও অনুমতি দেন তিনি।

যদিও প্রিগোশিনকে বেলারুশে ‘নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে, তবে তাঁর বাহিনী ভাগনার সিরিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এই দেশগুলোয় ভাগনার রাশিয়ার হয়ে বিভিন্ন লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল। সেখানে এখনো রাশিয়ার সঙ্গে বাহিনীটির নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাগনারের অংশীদারত্ব রয়েছে।

মারাত গাবিদুল্লিয়ান একসময় ভাগনারের হয়ে লড়াই করতেন। পরে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আফ্রিকা প্রিগোশিনের জন্য অপেক্ষা করছে, সিরিয়া অপেক্ষা করছে। সেখান থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই।’

আফ্রিকা কি প্রিগোশিনের ঠিকানা

তবে ভাগনারের জন্য একটি দুঃসংবাদ হলো, গতকাল মঙ্গলবার সৌদি আরবের টেলিভিশন চ্যানেল আল-হাদাথ দাবি করেছে, বিদ্রোহের পর সিরিয়ায় ওয়াগনারের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে রাশিয়ার সামরিক পুলিশ। সেখান থেকে বাহিনীটির চার কমান্ডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে আলেকসান্দ্রা গারমাঝাপোভা বলেন, আফ্রিকা হয়তো প্রিগোশিনের শেষ ঠিকানা হবে। বাকি জীবন তিনি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র বা আফ্রিকার অন্য দেশে কাটাবেন, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে সেখানেও প্রিগোশিন কতটুকু নিরাপদে থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, এর আগেও ঘনিষ্ঠ লোকজনকে সাজা দেওয়ার ব্যাপারে পুতিনকে ‘নৃশংস’ হতে দেখা গেছে। এমন একজন আলেকসান্দার লিতভিনেঙ্কো। পুতিনের বিরুদ্ধে কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংসের অভিযোগ তোলার পর এই গোয়েন্দ কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোগামী সড়কে ভাগনার যোদ্ধারা

প্রিগোশিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হবেন কি না, তা নিয়ে এখন অতটাও ভাবছেন না বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মূল ভাবনা এখন প্রিগোশিন ও ভাগনারে হাজার হাজার যোদ্ধার ভবিষ্যৎটা কী হবে, তা নিয়ে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাজ্যের এক্সেটার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কেভর্ক ওসকানিয়ান। তাঁর কথায়, ভাগনারের সব যোদ্ধা বা বাহিনীতে যাঁরা বাকি আছেন, তাঁদের কি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করা হবে? তাই যদি করা হয়, তাহলে সিরিয়া, আফ্রিকা ও অন্যান্য জায়গায় থাকা ভাগনার সদস্যদের কী হবে?

কেভর্ক ওসকানিয়ান বলেন, এখন যেমন দেখা যাচ্ছে, ভুল হিসাব–নিকাশের কারণে প্রিগোশিনকে রুশ অভিজাত বলয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে তাঁর ও ভাগনারের সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে, তা অনুমান করা কঠিন।

এখানেই সমাপ্তি নয়

গত মঙ্গলবার সকালে প্রিগোশিন বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে পৌঁছান। একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে তিনি সেখানে গিয়েছেন। সেখানে পৌঁছানোর পর বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো বলেছেন, ‘তিনি (প্রিগোশিন) এখন বেলারুশে। আমি যেমনটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিছুদিনের জন্য তিনি যদি আমাদের হয়ে কাজ করতে চান, তবে আমরা তাঁকে সাহায্য করব।’

তবে এখানে একটি ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ, রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে ভাগনার গ্রুপ যে অভিযান পরিচালনা করছিল, তা শেষ হয়নি।

এদিকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে পাঁচটি কেন্দ্রে এখনো যোদ্ধা নিয়োগ চলছে। পিটাসবার্গভিত্তিক বুমাগার ওয়েবসাইটে এ খবর প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটিকে ভাগনারের একজন ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, সেখানে ভাগনারের কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। সবকিছুই চলছে।  

বুমাগার খবরে বলা হয়েছে, তবে প্রিগোশিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এমন অনেক গণমাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক ছিল এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এ ছাড়া সেন্ট পিটার্সবার্গে ভাগনার গ্রুপের যে বিশাল ভবন ছিল, তা বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি ও ভালো আবহাওয়ার কারণে তাঁদের কর্মীদের ছুটি দেওয়া হয়েছে।

প্রিগোশিনের নির্বাসন, পুতিনের জন্য হুমকি

বলা হচ্ছে, বেলারুশেও প্রিগোশিনের থাকাটা প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য হুমকির। বিশেষ করে ভাগনারের যোদ্ধারা যদি রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না চান এবং তাঁরা যদি বেলারুশে চলে আসেন, তবে সেটা বড় হুমকি হবে পুতিনের জন্য। কারণ, প্রিগোশিনের জন্য বেলারুশে ইতিমধ্যে ঘাঁটি নির্মাণ শুরু করেছে।

এ প্রসঙ্গে কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সি কুশচ আল-জাজিরাকে বলেন, বেলারুশে প্রিগোশিনের অবস্থান পুতিনের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে। প্রিগোশিন ক্রেমলিন দখলের পাঁয়তারা করতে পারেন। এ জন্য তিনি স্মোলেস্ক হয়ে আক্রমণ চালাতে পারেন। এর আগে নেপোলিয়ন এই পথে রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন এবং মস্কোর দখল নিয়েছিলেন। রোস্তভ-অন-দন শহর যেভাবে দ্রুত দখল করা সম্ভব হয়েছিল, ওই পথে আক্রমণ করলে মস্কো খুব দ্রুত দখল করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন আলেক্সি কুশচ।

আলেক্সি কুশচ বলেন, লুকাশেঙ্কোর সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী দুর্বল। ফলে বেলারুশে আরও স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন প্রিগোশিন। তিনি বলেন, ভাগনার গ্রুপের সম্ভাবনা এখনো শেষ না করাই ভালো হবে। কারণ, রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ভাগনারকে বাধা দিয়েছে, এর চেয়ে প্রিগোশিনকে বেলারুশে কম বাধার মুখে পড়তে হবে।