ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধে আট মাস হলো নিজেকে সরাসরি যুক্ত করা থেকে দূরে রাখতে পেরেছে বেলারুশ। যদিও প্রতিবেশী ইউক্রেনে পুরোদমে সামরিক অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে রাশিয়ার একধরনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে দেশটি। গত ফেব্রুয়ারিতে বেলারুশের মাটি থেকেই রুশ সেনারা কিয়েভে অভিযান শুরু করেন।
মিনস্ক রুশ সেনাদের এখন পর্যন্ত লজিস্টিক সহযোগিতা, সরবরাহ লাইন ও চিকিৎসাসেবা এবং ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য বিমানবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে এসেছে। ইউক্রেনের দনবাস ও ক্রিমিয়া—এ দুই দখলকৃত অঞ্চলে মস্কো বেলারুশের ট্যাংক ও গোলাবারুদ পাঠিয়েছে বলেও বিভিন্ন খবরে জানা যায়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু থেকেই একদম ভালোভাবে নেয়নি বেলারুশের জনগণ। সম্প্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছেন বেলারুশের মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ।
তবে এ মাসের শুরুর দিকে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁর দেশ রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে পারে। ১০ অক্টোবর বেলারুশ নেতা ঘোষণা করেন, ইউক্রেন থেকে কথিত হামলার হুমকির জবাবে দেশটিতে ‘বেলারুশ–রাশিয়া যৌথ সামরিক দল’ মোতায়েন করা হতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বেলারুশের যে ভূমিকা, সেটি ঘিরে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উত্তেজনা বেড়ে যাওয়াকেই তুলে ধরছে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর এ ঘোষণা। এটি এ আভাসই দেয়, তিনি দেশের জনমতকে যুদ্ধের পক্ষে প্রস্তুত করছেন। যদিও রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাতের শুরু থেকেই বেলারুশের নাগরিকেরা ইউক্রেন যুদ্ধে সেনা পাঠানোর ঘোর বিরোধিতা করে আসছেন। আবার ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে লুকাশেঙ্কো বাস্তবসম্মত না হলেও রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাতে বেলারুশের অধিকতর সম্পৃক্ততার পক্ষে একটা আনুষ্ঠানিক যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন।
যাহোক, ইউক্রেন যুদ্ধে বেলারুশের সরাসরি অংশগ্রহণ মিনস্কের জন্য খুবই ঝুঁকির হতে পারে; এমনকি ক্রেমলিনের নিজের জন্যও। আর এটি সামলানো হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত কঠিন।
সম্প্রতি ইউক্রেনের দখল করা চার অঞ্চল রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য মস্কোর দাবির বিপরীতে লুকাশেঙ্কোর নিজস্ব কৌশল এ ঘটনায় চাপে পড়েছে। এখন আক্ষরিক অর্থে ক্রেমলিন এই দাবি করতে পারে যে দখল করা দনবাস ও খেরসনে ইউক্রেনের পাল্টা–আক্রমণ হবে ‘রুশ–বেলারুশ ইউনিয়ন স্টেটের’ বিরুদ্ধেই আক্রমণ। ইউনিয়ন স্টেটের এ ধারণা রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যকার এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
ক্রেমলিনের চাপে এমন জোটের সামরিক সহযোগিতা নিয়ে গত নভেম্বরেই এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন লুকাশেঙ্কো। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এর কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ সামগ্রিকভাবে জোটের বিরুদ্ধে হামলা বলে বিবেচিত হবে।
বেলারুশ–রাশিয়া যৌথ সামরিক গ্রুপ ‘ইউনিয়ন স্টেটের’ অভিন্ন প্রতিরক্ষা নীতির একটি অংশ। এ যৌথ সামরিক গ্রুপ মোতায়েনের ঘোষণার মাধ্যমে কার্যত প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো বেলারুশ ‘যুদ্ধপূর্ব পরিস্থিতিতে’ থাকার কথাই বলেছেন।
সামরিক অর্থে এ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ঠিক কী হতে পারে, তা স্পষ্ট নয়। এটিও স্পষ্ট নয়, বাহিনীর আকার কেমন হতে পারে। তবে লুকাশেঙ্কো ‘দ্রুত মোতায়েনের’ কথা বলেছেন। সাধারণভাবে এর মধ্যে থাকতে পারে সেনাসদস্যের সংখ্যা পূর্ণশক্তিতে উপনীত করা, গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা, যোগাযোগব্যবস্থা ও কার্যপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধপ্রস্তুতি জোরদার করা।
কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লুকাশেঙ্কো সরকারের যদি পতন হয়, তাহলে মহাবিপত্তিতে পড়বেন পুতিন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সংকটকালীন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সমর্থককে হারাবেন তিনি।
রিজার্ভ সেনাদের আংশিক নিযুক্তি ও আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সেনাদের যুদ্ধকালীন সতর্কাবস্থায় রাখাও লুকাশেঙ্কোর ‘দ্রুত মোতায়েনের’ ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেলারুশের মাটিতে এই সেনারা মাঝেমধ্যেই মহড়ায় অংশ নিয়েছেন।
এই মুহূর্তে বেলারুশের সেনাবাহিনীতে প্রায় ৬৫ হাজার সেনাসদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে নিয়মিত সেনা ৪৫ হাজার। তবে যুদ্ধের জন্য তাঁরা হয়তো অতটা প্রস্তুত নন। কারণ, বিগত সময়ে দেশটির সেনাদের একটি অংশকেই শুধু সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গোপনে নিজ দেশের সেনাদের সক্ষমতা ও তৎপরতা যাচাই করছে বেলারুশ।
বেলারুশের সেনাদের ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে লুকাশেঙ্কোকে চাপ দেওয়ার পেছনে পুতিনের বড় স্বার্থ রয়েছে। তবে এটা করা আদৌ যৌক্তিক হবে কি না, প্রশ্ন সেটি নিয়ে। বেলারুশে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লুকাশেঙ্কোকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করেছিল রাশিয়া। তখন থেকে তাঁর রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে ক্রেমলিন।
২০২০ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাশিয়ার দাবিদাওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কমেছে লুকাশেঙ্কোর। এ সময় তিনি মস্কোর সঙ্গে একাধিক চুক্তি করেছেন। বেলারুশের পররাষ্ট্রনীতিতে দেখা গেছে রাশিয়ার ছায়া। এর মধ্য দিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সার্বভৌমত্ব ক্রেমলিনের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি।
বেলারুশের সেনাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ঘাটতি রয়েছে। তাই তাঁরা রাশিয়ার জন্য কতটুকু কাজে আসবেন, সে বিষয়টিও মস্কোর কাছে হয়তো পরিষ্কার নয়। বেলারুশের সেনাদের নীতি–নৈতিকতাও কম বলে ধারণা করা হয়। এতে করে তাঁরা রাশিয়ার কাছে সম্পদের চেয়ে বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
এদিকে ইউক্রেনের সঙ্গে বেলারুশের সীমান্ত দিয়ে সম্মুখযুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে রাশিয়ারও উচ্চপ্রশিক্ষণ পাওয়া ও সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত সেনার অভাব রয়েছে। আর সীমান্তের এপারে নিজেদের অংশ মাইন দিয়ে সুরক্ষিত করে রেখেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এমনকি শত্রুসেনাদের অগ্রগতি রুখতে নিজেদের সেতুগুলো ধ্বংস করেছে তারা।
১০ অক্টোবর বেলারুশ নেতা ঘোষণা করেন, ইউক্রেন থেকে কথিত হামলার হুমকির জবাবে দেশটিতে ‘বেলারুশ-রাশিয়া যৌথ সামরিক দল’ মোতায়েন করা হতে পারে।
বেলারুশ সীমান্তে কোনো সামরিক তৎপরতা দেখতে পেলে ইউক্রেনীয় বাহিনী আগাম হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছেন কিয়েভের সমরবিদেরা। বেলারুশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো এ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এতে সীমান্ত পেরিয়ে দেশটির সেনাদের ইউক্রেনে প্রবেশ করানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারেন লুকাশেঙ্কো।
বেলারুশে সুশীল সমাজের কণ্ঠ পুরোপুরি রোধ করে রাখা হয়েছে। বিক্ষোভকারী আর বিরোধী দলের নেতারা এখন হয় কারাগারে, না হয় বিদেশে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে লুকাশেঙ্কো যদি সেনা সমাবেশ বা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে নিজ দেশের সেনাদের পাঠানোর ঘোষণা দেন, তাহলে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো খুবই কম।
এরপরও এ ধরনের পদক্ষেপ লুকাশেঙ্কোর জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু থেকেই একদম ভালোভাবে নেয়নি বেলারুশের জনগণ। সম্প্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছেন বেলারুশের মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ।
তাই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে সেনা পাঠালে লুকাশেঙ্কোর যে অল্পবিস্তর জনসমর্থন রয়েছে, তা আরও কমতে ও তাঁর সরকারকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। আর সীমান্তে বা ইউক্রেনে যু্দ্ধের জন্য সামরিক বাহিনী পাঠালে মিনস্কে তাঁকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য উচ্চপ্রশিক্ষিত সেনার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
বেলারুশের বিরোধী দলগুলোও এ অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। কারণ, ২০২০ সালে রাশিয়ার সহায়তায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিক্ষোভ দমনে সফল হয়েছিলেন লুকাশেঙ্কো। এখন অনেক বিরোধী শক্তিই সরকারের বিরুদ্ধে কম শান্তিপূর্ণ পথে এগোনোর আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে বেলারুশের ওপর নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা দেশগুলো কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেবে। এতে দেশটির নড়বড়ে অর্থনীতি আরও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ফলে দেশে লুকাশেঙ্কোর দুর্নাম আরও বাড়বে। আর সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করাটা বিরোধীদের জন্য আরও সহজ হয়ে পড়বে।
এমন কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লুকাশেঙ্কো সরকারের যদি পতন হয়, তাহলে মহাবিপত্তিতে পড়বেন পুতিন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সংকটকালীন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সমর্থককে হারাবেন তিনি।
সবশেষে বলা যায়, ইউক্রেনে বেলারুশের সেনা মোতায়েন হয়তো রাশিয়ার জন্য অত ফলদায়ক হবে না। এতে লুকাশেঙ্কো সরকার ক্ষমতাছাড়া হতে পারে। মনে হয় এ বিষয়গুলো পুতিনের মাথায় আছে। আর সে হিসাব কষেই সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।