শহরে বেশ বড় একটি অভিজাত স্কুল রয়েছে। আছে সরু রাস্তা। একটি খাঁড়া উপত্যকার দুপাশ ধরে সারিবদ্ধ বাড়িও আছে। শহরের ঠিক মাঝখানে প্রাচীন একটি ঝরনা। আরও আছে গির্জা আর পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের এজিয়ান সাগরের নীল জলরাশি উপভোগের সুযোগ।
কিন্তু, কী আশ্চর্য! এমন সুন্দর শহরটিতেই এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে মানুষের বসবাস নেই।
এটি তুরস্কের দক্ষিণ–পশ্চিমের মুগলা প্রদেশের ছোট পাহাড়ি শহর কায়কোয়; যেটি পরিণত হয়েছে সত্যিকার এক ভুতুড়ে শহরে।
অথচ এক শতাব্দী আগেও ব্যস্ত শহর ছিল কায়কোয়। লেভিসি নামেও পরিচিত ছিল এটি। শহরে অন্তত ১০ হাজার গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী বসবাস করতেন। তাঁদের অনেকেই ছিলেন হস্তশিল্পী। স্থানীয় মুসলিম কৃষকদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন তাঁরা।
কিন্তু স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে তুরস্কের উত্থানকে ঘিরে অভ্যুত্থান শুরু হলে শহরটির বাসিন্দাদের সহজ–সরল জীবন বিনষ্ট হয়।
১৯২২ সালে গ্রিক-তুর্কি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রতিবেশী গ্রিসের সঙ্গে নতুন করে তুরস্কের উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় উভয় দেশ একে–অপরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। যার অর্থ, কায়কোয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে গ্রিসের কাভালায় বসবাস করা মুসলিম তুর্কি বাসিন্দাদের জোরপূর্বক স্থানবিনিময় করা হয়।
কিন্তু কাভালার মুসলিম তুর্কিরা কায়কোয় নতুন আবাস নিয়ে মোটেও খুশি ছিলেন না। ফলে তাঁরা দ্রুত শহর ত্যাগ করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে প্রাণচঞ্চল কায়কোয় পরিণত হয় ভুতুড়ে এক শহরে।
কাভালার মুসলিম তুর্কিরা কায়কোয় নতুন আবাস নিয়ে মোটেও খুশি ছিলেন না। ফলে তাঁরা দ্রুত শহর ত্যাগ করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে প্রাণচঞ্চল কায়কোয় পরিণত হয় ভুতুড়ে এক শহরে।
যে অল্পসংখ্যক মানুষ তখনো কায়কোয় থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আইসান একিজের দাদা-দাদিও ছিলেন। একিজের পরিবার এখন কায়কোয় প্রবেশের প্রধান পথের ধারে ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁ চালায়। যেসব পর্যটক কায়কোয় শহর ঘুরতে আসেন, তাঁদের জন্য খাবার, পানীয় ও স্মারক পণ্য বিক্রি হয় এ রেস্তোরাঁয়।
সেই কঠিন সময়ের গল্প প্রজন্ম ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে একিজের পরিবার। একিজ বলেন, ‘আমার দাদা-দাদি আমাকে বলেছেন, বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় গ্রিক লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁরা এখান থেকে যেতে চাননি। এমনকি কেউ কেউ তাঁদের তুর্কি বন্ধুদের জিম্মায় সন্তানদের রেখে গিয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস ছিল, তাঁরা আবার এখানে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু সেই সুযোগ কখনো পাননি তাঁরা।’
একিজ জানান, তাঁর দাদা-দাদি মেষ পালন করতেন। সহজেই শহরের শেষ প্রান্তে এসে নতুন জীবনে খাপ খাইয়ে নেন তাঁরা। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই অন্যত্র চলে যান। কায়কোয় শহরের বেশির ভাগ বাড়ির দেয়াল নীল রঙের ছিল। খুব সম্ভবত বিচ্ছু ও সাপ তাড়াতে গ্রিকরা এটা করেছিলেন।
কায়কোয় প্রায় আড়াই হাজার বাড়ি ছিল। বাড়ির যেসব দেয়াল এখনো টিকে আছে, সেগুলোতে নীল রঙের ছোঁয়া এখনো বোঝা যায়। দশকের পর দশক ধরে খালি পড়ে থাকার পরও কিছু বাড়ির অন্দরসজ্জাও বোঝা যায়।
প্রকৃতিও কায়কোয়কে ভুতুড়ে শহরে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছে বলে মত জ্যান আকাতাইয়ের। পর্যটকদের কায়কোয় ঘুরতে নিয়ে যায় এমন এটি প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি।
আকাতাই বলেন, ‘এখানে ভূমিকম্প হয়, ঝড় হয়। আবহাওয়া, জলবায়ু, ঝড়বৃষ্টি...সবকিছুই চমৎকার এ জায়গার ওপর প্রভাব ফেলেছে।’
একটি ছোট দোকানে মাত্র তিন ইউরো ফি দিয়ে পর্যটকেরা কায়কোয় শহরে প্রবেশের সুযোগ পান। এরপর হেঁটে উপভোগ করতে পারেন শহরের অমূল্য দৃশ্যপট।
শহরের শতাব্দীপ্রাচীন পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর বেশির ভাগের ছাদ ধসে পড়েছে। ভাঙা দেয়াল ঢেকে গেছে লতাগুল্মে। তবে অনেকগুলো এখনো অনেকটা আগের আকৃতিতে রয়ে গেছে। তবে এখানে সুপেয় পানি দুর্লভ।
একসময় শহরের সবচেয়ে নামীদামি ভবনগুলোর একটি ছিল ‘আপার চার্চ’। এটির গোলাপি দেয়াল এখন বিবর্ণ। জরাজীর্ণ ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। তবে শহরের নানা প্রান্ত থেকে এটির সৌন্দর্য এখনো উপভোগ করা যায়।
তুরস্কের আঙ্কারা থেকে ওই শহরে বেড়াতে এসেছেন উইজিত উলাত উজতিমুর। শহরটি ঘুরে বেড়ানোর পর সেটিকে তিনি ‘আমাদের অন্ধকার অতীত’ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেন, ‘এটা একসময় খ্রিষ্টানদের গ্রাম ছিল; এখন যা দেখতে পাচ্ছি, সেটা অতীতের তিক্ত ঘটনার প্রতিফলন।’
এই পর্যটক আরও বলেন, ‘এখনো যেহেতু বেশির ভাগ ভবন অক্ষত আছে, তাই আপনি এলে, এখানকার জীবন আসলে কেমন ছিল, তা অনুভব করতে পারবেন।’