রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেনে কি ‘ট্যাকটিক্যাল’ পারমাণবিক বোমা হামলা চালাবেন পুতিন

কিছুদিন ধরে ইউক্রেনে পুতিন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবেন কি না, সেই সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা চলছে
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে ‘ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন’ বা ‘সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র’ ব্যবহার করবেন না বলে নিজ ধারণার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যদিও তাঁর এ ধারণা প্রকাশের আগে পুতিন হুমকি দিয়েছেন, নিজেদের ভূখণ্ড (সম্প্রতি রাশিয়ায় যুক্ত করা ইউক্রেনের চার অঞ্চলসহ) রক্ষায় রাশিয়া হাতে থাকা সব অস্ত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে।

গত মঙ্গলবার মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকার দেন জো বাইডেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ভ্লাদিমির পুতিনের সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি কতটা বাস্তবসম্মত? জবাবে বাইডেন বলেন, ‘আচ্ছা, আমার মনে হয় না, তিনি (পুতিন) এমন কিছু করবেন।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনে জিতেছেন বলার মতো কিছু না পেয়ে যদি পুতিনকে এ যুদ্ধ শেষ করতে হয়, তবে রাশিয়ার পরাশক্তির মর্যাদা ধরে রাখার জন্য হলেও ইউক্রেনে মস্কোর পারমাণবিক হামলার ঝুঁকি বাড়বে।

কিন্তু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দখল করা কিছু এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে রুশ বাহিনী। তাই পরাজয় এড়াতে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার আশঙ্কা এখনো রয়েছে। সে আশঙ্কা কম হলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

স্বাভাবিকভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র, বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ অস্ত্রের বৈশিষ্ট্য কী, কেনইবা এ নিয়ে এত আলোচনা, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে।

সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে রাশিয়ার হাতে ফাইল

‘সুনির্দিষ্ট কৌশলগত’ পারমাণবিক অস্ত্র কী

সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে আকার, নির্দিষ্ট দূরত্বে আঘাত হানার সক্ষমতা ও সীমিত দূরত্বে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে এমন অস্ত্রকে সাধারণভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়ে থাকে। সাধারণত প্রচলিত বোমার চেয়ে এমন ধরনের পারমাণবিক বোমা আকারে অনেক বড়। এ অস্ত্রের ব্যবহারে বিস্ফোরণস্থল থেকে অনেক দূর পর্যন্ত তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ ঘটে ও অন্যান্য ধ্বংসাত্মক ক্ষতি হয়। সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার মতো বোমার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দখল করা কিছু এলাকা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে রুশ বাহিনী। তাই পরাজয় এড়াতে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার আশঙ্কা এখনো রয়েছে। সেই আশঙ্কা কম হলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রকে প্রায়ই ‘নন–স্ট্র্যাটেজিক ওয়েপনস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়; যা ‘স্ট্র্যাটেজিক ওয়েপনস’ বা ‘কৌশলগত অস্ত্র’ থেকে আলাদা।

কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের (অকল্পনীয় ধ্বংসক্ষমতার থার্মোনিউক্লিয়ার/হাইড্রোজেন বোমা) তুলনায় সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র স্বল্প দূরত্বে ব্যবহার করা হয়।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, শত্রু পক্ষের ‘লড়াইয়ের ক্ষমতা ও ইচ্ছাকে’ নিশানা করে তৈরি করা হয় কৌশলগত অস্ত্র। এ নিশানাগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ত্রের উৎপাদন, অবকাঠামো, পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থাসহ অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু।

বিপরীতে সুনির্দিষ্ট কৌশলগত অস্ত্র কোনো লড়াইয়ে জেতার লক্ষ্যে অধিকতর ছোট পরিসরে ও তাৎক্ষণিক ফল পেতে ব্যবহার করা হয়। ‘ট্যাকটিক্যাল ওয়েপনস’ কথাটি সাধারণত এমন সব অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেগুলো লক্ষবস্তুতে আঘাত হানার পর বিস্ফোরণজনিত তেজস্ক্রিয়তা বেশি দূর পর্যন্ত ছড়াবে না ও তুলনামূলকভাবে কম প্রাণহানি ঘটবে।

ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে রুশ বাহিনীর বিধ্বস্ত ট্যাংক

ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া বোমা অথবা কামানের গোলায় করে সুনির্দিষ্ট কৌশলগত অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো যায়। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে ও বিভিন্ন মহাসাগরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানায় সক্ষম আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) তুলনায় এ অস্ত্রের পাল্লা হয় অনেক কম।

আল–জাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলাসের মতে, লড়াইয়ের ময়দানে সামরিক কমান্ডারদের অধিকতর সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয় সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র। গত শতকের মাঝামাঝি যখন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা (স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিয়ার ওয়েপন) তৈরি ও এর পরীক্ষা চলছিল, তখন সমরবিদেরা ভেবেছিলেন, ‘কৌশলগত’ পরিস্থিতিতে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র বেশি কার্যকর হবে।

কোন কোন দেশের এ অস্ত্র আছে

বিশ্বে পারমাণবিক বোমার অধিকারী দেশগুলোর অনেকেরই সাধারণত স্বল্পপাল্লার বা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন রয়েছে। রাশিয়ার অস্ত্রাগারে এ পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র আছে এক থেকে দুই হাজার। সর্বশেষ গত মার্চে এ হিসাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিস (সিআরএস)। বিশ্বের মাত্র ৯টি দেশের হাতে যে প্রায় ১২ হাজার ৭০০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, এর ৯০ শতাংশ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের।

পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট পুতিন অনেকবারই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে এ হুমকি দিয়েছেন, রাশিয়ার ওপর হামলা হলে সেটা হবে উসকানিমূলক এবং এ ধরনের যেকোনো হামলার জবাব পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে দিতে বাধ্য হবে রাশিয়া।

পুতিন আরও বলেছেন, ১৯৪৫ সালে জাপানের দুই শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশ্বে এমন বোমা হামলার নজির সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আনুমানিক ২৩০টি ট্যাকটিক্যাল বা নন–স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০টিই বি৬১ বোমা। ইউরোপে এগুলো মোতায়েন করা আছে। গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। পিয়ংইয়ং বলছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র হামলার লক্ষ্যে এটা তৈরি করেছে তারা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর কোরিয়া যদি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা শুরু করে, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় এমন পারমাণবিক বোমার পরীক্ষাও চালাতে পারে তারা।

ইউক্রেনে কি এ অস্ত্র ব্যবহার করা হবে

পুতিন ইউক্রেনে পারমাণবিক হামলা চালাবেন কি না, বাইডেন তা নিয়ে সম্প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলেও তিনি এর আগে ব্যাপারটি নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমনকি ছোট পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারও বিশ্বে যে অস্থিরতা তৈরি করবে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সপ্তাহখানেক আগে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে সুনির্দিষ্ট কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সহজ ব্যবহার ও বিশ্বজুড়ে বড় কোনো বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এটা শেষ না হওয়ার মতো কোনো বিষয় আছে।’

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের একসময়ের অচিন্তনীয় বিষয়ও এখন আশঙ্কা হয়ে দেখা দিচ্ছে। অতিসম্প্রতি ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মুখে দখলে থাকা কিছু এলাকা থেকে রুশ বাহিনী পিছু হটায় বাড়ছে সে আশঙ্কা। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এমন অস্ত্রের ব্যবহারের কথা ভাবেননি সমরবিদেরা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনে জিতেছেন বলার মতো কিছু না পেয়ে যদি পুতিনকে এ যুদ্ধ শেষ করতে হয়, তবে রাশিয়ার পরাশক্তির মর্যাদা ধরে রাখার জন্য হলেও ইউক্রেনে মস্কোর পারমাণবিক হামলার ঝুঁকি বাড়বে।