বিবিসির প্রতিবেদন

যে ইউক্রেনীয় শহরে রুশ বাহিনী এখনো এগোচ্ছে

রুশ বাহিনীর হামলায় ধসে যাওয়া একটি সেতু পার হচ্ছেন এক দম্পতি। বাখমুত, দোনেৎস্ক, ইউক্রেন, ৬ অক্টোবর
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রায় আট মাসে গড়াল। কিছুদিন ধরে ইউক্রেনীয় সেনাদের পাল্টা-আক্রমণের মুখে দেশটির পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে কিছু এলাকা থেকে পিছু হটেছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনীয় সেনারা এসব এলাকায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলের শহর বাখমুত দখলে নেওয়া এখনো রুশ বাহিনীর লক্ষ্য। অন্য এলাকায় রুশ বাহিনী পিছু হটলেও বাখমুত শহরে তারা অগ্রগতি অর্জন করছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে শহরটিতে দিনরাত অবিরত গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।    

বাখমুত শহরের বাসিন্দা প্রায় ৭০ হাজার। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। আর যাঁরা শহরে রয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই বয়োজ্যেষ্ঠ। বিদ্যুৎ ও পানির সংকট নিয়ে দিনযাপন করছেন তাঁরা। রাশিয়ার অবিরত হামলার মুখে শহরটির বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। এখন উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। সম্প্রতি নিরাপদ স্থানে নেওয়ার জন্য বাসিন্দাদের দীর্ঘ সারিও দেখা গেছে। মিনিবাসে করে তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে যাঁরা শহর ছাড়ার অপেক্ষা করছিলেন, তাঁদের একজন ওলেনা। বয়স প্রায় ৭০। ওলেনা বলেন, ‘মানুষ ক্লান্ত ও অবসন্ন।’ গোলাবর্ষণ আর গোলাগুলির শব্দ শহরটির বাসিন্দাদের আরও একবার নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে ভিন্নভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। ওলেনার ভাষ্য অনুযায়ী, শহর ছাড়তে চান, এমন মানুষদের কেউ সিগারেট খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কেউ মুখে দিয়ে চিবানো যায় এমন কিছু খুঁজছেন। এর মধ্যে আবার অনেকেই শুধু বসে আছেন এবং কাঁদছেন।

ওলেনা বলেন, জীবন খুব কঠিন হয়ে গেছে। খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে খাবারের বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে। বালতিতে করে আনতে হচ্ছে পানি। ওলেনা শহর ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন। শহর ছাড়ার আনন্দে বাসে তালি দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘যে এ যুদ্ধ শুরু করেছে, তাকে অভিশাপ দিচ্ছি, শত শতবার অভিশাপ দিচ্ছি।’              

বাখমুতে যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে দিতে চাইছে রাশিয়া। ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা-আক্রমণেও রুশ বাহিনী যেসব এলাকা থেকে পিছু হটেনি, তার মধ্যে একটি হলো এই বাখমুত। রুশ বাহিনী এখানে অগ্রগতি করছে। তবে এর গতি ধীর ও এর জন্য তাদের বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে রুশ বাহিনী সেখানে অবস্থান শক্ত করছে।  

বাখমুতের দখল নেওয়ার বিষয়টিতে রাশিয়ার গুরুত্ব দেওয়া নিয়ে একসময় শক্ত যুক্তি ছিল। গ্রীষ্মের শুরুতে রুশ বাহিনী এর পার্শ্ববর্তী শহর সেভেরোদোনেৎস্ক ও লিসিচানস্কের দখল নিয়েছিল। পরের লক্ষ্য হয়তো ছিল বাখমুত। ধারণা করা হচ্ছিল, এরপরে রাশিয়ার সেনারা ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের দিকে অগ্রসর হবে। কিন্তু এর মধ্যেই আচমকা ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে পাল্টা-আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। রুশ বাহিনী পিছু হটে ও আরও উত্তরে সরে যেতে বাধ্য হয়। গত জুলাইয়ে রাশিয়ার আর্টিলারি বাহিনীর গোলার লক্ষ্যবস্তুর আওতায় ছিল ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্ক শহর। তবে এখন আর তা নেই। কৌশল বদলে এখন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রুশ বাহিনী।        

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মুখপাত্র কর্নেল সেরহিই চেরেভাতি বলছেন, বাখমুতের দখল নেওয়ার মতো সেনা ও সরঞ্জাম রাশিয়ার কাছে আছে কি না, এ ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। বাখমুতের দখল নেওয়া এখন রুশ বাহিনীর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ইউক্রেনের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, রাশিয়ার সেনারা এখন আরও উত্তরে স্ভাতোভ ও ক্রেমেননা শহরের চারপাশ ঘিরে প্রতিরক্ষা বলয় গড়তে চাচ্ছেন। সেখানেও রুশ বাহিনীর প্রধান সরবরাহব্যবস্থা এখন ইউক্রেনীয় সেনাদের হামলার হুমকির ঝুঁকিতে রয়েছে।      

কর্নেল চেরেভাতি আরও বলেন, রাশিয়া সেখানে নতুন করে আরও কত সেনা সমাবেশ করতে পারবে এবং নতুন করে আসা এসব রিজার্ভ সেনার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে তাঁরা কতটা সফল হবেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যেটা দেখেছি, তাতে তাঁদের অবস্থা ভালো নয় এবং তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্রও নেই।’

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের এই মুখপাত্রের দাবি, রাশিয়া সম্প্রতি সেখানে ট্যাংক পাঠিয়েছে। টি৬২ নামের এসব ট্যাংক অনেক পুরোনো। গত শতকের ষাটের দশকে এসব ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বহু অত্যাধুনিক সাঁজোয়া যান ধ্বংস হওয়ায় রাশিয়া এসব ট্যাংক পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন, ইউক্রেন যুদ্ধে আরও তিন লাখ সেনা পাঠানো হবে। শুক্রবার পুতিন বলেছেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব সেনাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর কাজ শেষ হবে। কিন্তু বাখমুতের দখল নেওয়ার জন্য রাশিয়া যে লড়াই করছে, তাতে নেতৃত্বে আছে বেসরকারি সামরিক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপ, এমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দাদের। ২০১৪ সাল থেকে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের দিয়ে ইউক্রেনে লড়াই চালাচ্ছে রাশিয়া। গত মাসে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান রাশিয়ার একটি কারাগারে সেনা নিয়োগ করছেন। তিনি সেখানে থাকা বন্দীদের বলছেন, ‘হয় বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সেনাদের এবং বন্দীদের যুদ্ধ করতে হবে, নয়তো যাঁর যাঁর সন্তানকে পাঠাতে হবে।’