রাশিয়ার সদ্যপ্রয়াত সরকারবিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া। এক সময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতেন তিনি। বলতেন, জীবনে একজন স্ত্রী ও মা হিসেবে হিসেবেই মূল ভূমিকাটা পালন করতে চান। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ নেই।
তবে সময় বদলেছে। গত শুক্রবার রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের একটি কারাগারে নাভালনির মৃত্যু হয়। এরপর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সামনে আবেগপূর্ণ এক ভাষণে ইউলিয়া বলেন, তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এর বিচার চান।
এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার নিপীড়ন–নির্যাতনের শিকার সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে একটি গুরুপূর্ণ চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ইউলিয়া নাভালনায়া।
ইউলিয়ার অতীত যেমনই হোক না কেন, সব সময়ই স্বামীর বড় সমর্থক ছিলেন তিনি। ২০২০ সালে যখন অ্যালেক্সি নাভালনির শরীরে ‘নোভিচক’ বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তখনও তাঁকে তৎপর দেখা গিয়েছিল। জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য স্বামীকে রাশিয়ার বাইরে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
নাভালনির সমর্থকদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করেছিল তাঁর ও ইউলিয়ার প্রণয় ও সংসার জীবন। ইউলিয়াকে বলা হতো রাশিয়ার বিরোধী ‘ফার্স্ট লেডি’। নাভালনিও বলেছিলেন, ইউলিয়াকে ছাড়া একাকি ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন না তিনি। মস্কোর সমালোচনায় এতটা দুর্বার হতেও পারতেন না।
ইউলিয়ার পারিবারিক নাম ছিল ইউলিয়া আমব্রোসিমোভা। জন্ম ১৯৭৬ সালে মস্কোয়। তাঁর বাবা ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী বোরিস আমব্রোসিমভ। ইউলিয়া অর্থনীতিতে স্নাতক করেন। সে অনুযায়ী চাকরি শুরু করেছিলেন ব্যাংকে। তবে দুই সন্তানের জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। নাভালনিও তত দিনে রাশিয়ার একজন বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছেন।
নাভালনি ও ইউলিয়ার দেখা হয়েছিল তুরস্কে, ১৯৯৮ সালে। এর দুই বছর পর বিয়ে করেন দুজন। তখন কিন্তু নাভালনির ভবিষ্যৎ জনপ্রিয়তার কোনো আঁচ পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালে রুশ সাপ্তাহিক সোবেসেদনিককে ইউলিয়া বলেছিলেন, ‘আমি বিখ্যাত হতে যাওয়া কোনো আইনজীবী বা বিরোধীদলীয় নেতাকে বিয়ে করিনি। আমি বিয়ে করেছিলাম অ্যালেক্সি নামের এক তরুণকে।’
নাভালনির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইউলিয়া নাম লিখিয়েছিলেন চলতি শতকের শুরুর দিকে। সে সময় দুজনই লিবারেল ইয়াবলোকো পার্টির সদস্য ছিলেন। তবে নাভালনির শরীরে বিষপ্রয়োগের আগ পর্যন্ত তিনি বলতে গেলে আড়ালেই ছিলেন। জনসম্মুখে আসতেন খুবই কম। তেমন কথা বলতেও দেখা যেত না।
২০২০ সালের আগস্টে বিষপ্রয়োগের পর নাভালনিকে অসুস্থ অবস্থায় সাইবেরিয়ার ওমস্ক শহরে নেওয়া হয়েছিল। তখন সরাসরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে চিঠি লিখেছিলেন ইউলিয়া। তাতে নাভালনিকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
পরে জার্মানিভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থার সহায়তায় নাভালনিকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ার বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়। কয়েক মাস পর চিকিৎসা শেষে স্বামীকে নিয়ে দেশে ফেরেন ইউলিয়া। এর পরপরই নাভালনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে কারাগারে।
ইউলিয়াকে একজন ‘আদর্শবান ও নির্ভীক’ নারী হিসেবে সম্বোধন করতেন রাশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউল। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘নাভালনি কখনোই ইউলিয়ার চেয়ে ভালো জীবনসঙ্গী পেতেন না। স্বামীর বিশ্বাস, সাহস ও নির্ভীকতা ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনি।’
স্বামীর মৃত্যুর পর ইউলিয়া একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ ও সুখী রাশিয়া চাই। আমার স্বামী রাশিয়াকে চমৎকার করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর স্বপ্নে দেখা সেই দেশটিই আমি আপনাদের সঙ্গে নিয়ে গড়তে চাই। দেশের জন্য যে অকল্পনীয় আত্মত্যাগ তিনি করেছেন, তা আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।’