প্লাস্টিক–বর্জ্যের সমস্যা বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে প্রকট হয়ে উঠছে। প্লাস্টিকের বিকল্প ও পুনর্ব্যবহারের কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না। জার্মান বিজ্ঞানীরা এবার নতুন উপায়ে প্লাস্টিক ধ্বংসের উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে সে জন্য ৬০–৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রা প্রয়োজন।
প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান করতে লাইপসিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট ক্রিস্টিয়ান সনেনডেকারের টিম জৈব প্রযুক্তি কাজে লাগাতে চায়। সেই প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা দিয়ে সনেনডেকার বলেন, ‘প্রকৃতির কাজ পর্যবেক্ষণ করে আমরা সেটা নকল করার চেষ্টা করছি। পলিমার ভেঙে দিতে প্রকৃতি এনজাইম ব্যবহার করে। আমরাও এখন ঠিক সেটাই করছি।’
লাইপসিশ শহরের দক্ষিণের কবরস্থানে ক্রিস্টিয়ান ও তাঁর এক সহকর্মী সেই এনজাইম খুঁজে পেয়েছেন। কম্পোস্টের মধ্যে সেটা পাওয়া গেছে। সেই এনজাইম আসলে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া পাতার পচন ঘটায়।
সনেনডেকার বলেন, ‘এমন এক পাতার ওপরে মোমের স্তর রয়েছে, যাকে কাটিন লেয়ার বলা হয়। সেটা একধরনের পলিয়েস্টর। এটা একটা পলিমার, যার কাঠামো ঠিক পিইটি প্লাস্টিকের মতো এস্টার বন্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। অনেক জৈব প্লাস্টিকের মধ্যেও এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এসব এনজাইম এতটাই অনির্দিষ্ট যে সেটি পলিয়েস্টার স্পেকট্রামের এক বিস্তীর্ণ রেঞ্জ শনাক্ত ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। সেটা আমাদের সুবিধা ও সৌভাগ্যও বটে। কারণ, আমাদের প্লাস্টিকের সমস্যার জৈব জবাব পাওয়া গেছে।’
সেই এনজাইম কত দ্রুত প্লাস্টিক ভাঙতে পারে, ক্রিস্টিয়ান সনেনডেকার তা হাতেনাতে করে দেখাচ্ছেন। ৬০–৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এনজাইম মাত্র এক দিনেই পিইটি মোড়ক পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারে। তখন শুধু মৌলিক উপাদানগুলো পড়ে থাকে। গবেষকেরা সেই এনজাইম পেয়ে খুব খুশি।
ক্রিস্টিয়ান সনেনডেকার বলেন, ‘আমরা সেটার নাম রেখেছি পিএইচএল সেভেন। অর্থাৎ পলিয়েস্টার-হাইড্রোলেজ-লাইপসিশ। এটা আমাদের পাওয়া ৯টির মধ্যে ৭ নম্বর এনজাইম। সেটা ছিল বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন এনজাইম।’
এনজাইমটি দৃশ্যমান করে তুলতে সেটির থ্রি–ডি প্রতিরূপ প্রিন্ট করা হয়েছে। এর ফলে সেটির ক্রিয়া বোঝানো সহজ হয়েছে। সনেনডেকার বলেন, ‘এই হলো সেই এনজাইম। পিইটি শৃঙ্খলের প্রতিটি এস্টার বন্ড দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ পূর্বনির্ধারিত ব্রেকিং পয়েন্ট। এবার এনজাইম এসে একেকটি এস্টার বন্ড চিবিয়ে খাচ্ছে। প্রক্রিয়ার শেষে টেরেফথালিক অ্যাসিড ও ইথিলিন গ্লাইকলের মতো মৌলিক উপাদান অবশিষ্ট থাকে। সেসব দিয়ে নতুন করে প্লাস্টিক তৈরি করা যায়।’
সনেনডেকারের টিম এবার আরও এক ধাপ এগিয়েছে। তারা এনজাইমের ডিএনএ এমনভাবে পরিবর্তন করতে চায়, যাতে সেটি আরও দ্রুত প্লাস্টিক খেয়ে নিতে পারে। সেই লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি পরিবর্তিত এনজাইম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিটি আলাদা করে বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে দক্ষ এনজাইম বেছে নিতে চায় তারা।
প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই কাজে সহায়ক হচ্ছে। বায়োটেকনোলজিস্ট রনি ফ্রাংকের সঙ্গে মিলে গবেষকেরা সেই কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘এবার আমরা বড় আকারে আমাদের প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা নতুন প্রোটোটাইপ তৈরি করেছি, যার সাহায্যে প্রায় ১০০টি এনজাইমের নমুনা বিশ্লেষণ করতে পারি। একই সঙ্গে ওপরের স্তরগুলো পরিমাপ করতে পারি। সেই প্রয়োজনীয় তথ্য এআইকে জোগান দিয়ে আমরা প্রশিক্ষণও দিতে পারি। এভাবে আরও নতুন ও উন্নত এনজাইম খুঁজে বের করে আমরা প্লাস্টিক ভেঙে দিতে পারি।’
সুপার এনজাইমের সন্ধানে গবেষেকেরা দিনে কয়েক হাজার এনজাইম বিশ্লেষণ করতে চান। তাঁদের আরও এক ধাপ এগোনোর স্বপ্নও রয়েছে। সনেনডেকার বলেন, ‘আমরা চাই, শেষ পর্যন্ত বাজারে আরও বেশি পলিয়েস্টার নিয়ে কাজ হোক। কারণ, এনজাইম কাজে লাগিয়ে সেগুলো ভেঙে ফেলা অনেক সহজ। এভাবে আমরা সত্যি কার্যকর চক্রাকার অর্থনীতি সৃষ্টি করতে পারি। এই মুহূর্তে প্লাস্টিক–বর্জ্যের কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এর ফলে আমাদের কাছে এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা এমন কিছু করতে চাই, যাতে টেকসইভাবে প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যায়।’