ডেনমার্ক উপকূলের বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে যাওয়া দুটি গ্যাস পাইপলাইনে অস্বাভাবিক ফাটল বা ছিদ্র দেখা দিয়েছে। এটি নাশকতা কি না, এ বিষয়ে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিমধ্যে এ জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে এটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ইউক্রেন। এ পাইপলাইনগুলো স্থায়ীভাবেও বন্ধ হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খবর আল–জাজিরার
নর্ডস্ট্রিম-১ ও নর্ডস্ট্রিম-২ পাইপ লাইনে এ ফাটল দেখা দিয়েছে। ডেনমার্কের সামরিক কমান্ড গত মঙ্গলবার একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, বর্নহোম দ্বীপের কাছে সমুদ্রের পানির উপরিভাগে বুদ্বুদ উঠছে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী বলছে, পাইপলাইনে বেশ বড়সড় ছিদ্র হয়েছে। তাদের ধারণা, এক কিলোমিটারেরও বেশি ব্যাসার্ধজুড়ে ছিদ্রের কারণে বুদ্বুদ সৃষ্টি হচ্ছে।
ইউরেশিয়ার বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশালাকারের ছিদ্রের মানে হলো, নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনগুলো দিয়ে এ শীতে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব নয়। এমনকি এগুলো মেরামত করার পরও নয়।
বিশ্লেষক হেনিং গ্লোইস্টেইন ও জেসন বুশের মতে, এত বড় ছিদ্রের কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে, পাইপলাইনগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ আকারের ছিদ্র গুরুতর নিরাপত্তাঝুঁকি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়া যদি এ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ না করে।
ডেনমার্কের জ্বালানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গ্যাসলাইনের এ ছিদ্র কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজগুলো এ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ। ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া গ্যাস বাতাসে মিশে বায়ুদূষণের কারণ হতে পারে।
তবে শুধু যে এলাকায় পাইপলাইনে ছিদ্র দেখা দিয়েছে, শুধু সে এলাকার পরিবেশে এর প্রভাব পড়তে পারে। ডেনমার্কের কর্তৃপক্ষ বলছে, পাইপলাইনে ছিদ্র পাওয়ার পর ডেনমার্কের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সেক্টরে উৎপাদনের মাত্রা বাড়ানো হবে। জ্বালানি খাতে উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে এ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা প্রয়োজন।
গত মঙ্গলবার সুইডেনের মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানিয়েছে, তারা সুইডিশ ও ডেনিশ জলসীমায় নর্ডস্ট্রিম–১-এ দুটি ছিদ্রের বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিল।
রয়্যাল ডেনিশ ডিফেন্স কলেজের সেন্টার ফর মেরিটাইম অপারেশনের গবেষক অ্যান্ডার্স পাক নিলসেন বলেছেন, বাল্টিক সাগরের তলদেশে পাইপের ছিদ্রের ঘটনা এমন সময়ে ঘটল, যখন নতুন উপায়ে নরওয়ের গ্যাস পোল্যান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত কেউ নরওয়েজিয়ান গ্যাসে কিছু ঘটতে পারে এমন একটি সংকেত পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে গ্যাসের বাজারে আরও বিশৃঙ্খলার ফলে আসলে কে লাভবান হবে? আমি মনে করি, এ মুহূর্তে শুধু একজনই এ থেকে উপকৃত হবে, তা হলো রাশিয়া।’
সিসমোলজিস্টরা বলছেন, গ্যাসের পাইপলাইন ছিদ্র হওয়ায় আগে পানির নিচে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ হয়েছে। সুইডেনের ন্যাশনাল সিসমোলজি সেন্টারের জর্ন লুন্দ বলেন, এগুলো যে বিস্ফোরণ ছিল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত আগস্ট থেকে নর্ডস্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে রাশিয়া। নর্ডস্ট্রিম–১ ও নর্ডস্ট্রিম–২ রাশিয়ার মালিকানাধীন অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাইপলাইন।
নর্ডস্ট্রিম-১ নামের পাইপলাইনে ছিদ্র আছে জানিয়ে রাশিয়ার মালিকানাধীন গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম এ মাসের শুরুর দিকে জানিয়েছিল, এ লাইন দিয়ে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। ফলে ইউরোপের দেশগুলোয় ইতিমধ্যে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহের বিকল্প উৎস খুঁজে পেতে এখনো ঘাম ঝরাচ্ছেন ইউরোপের নেতারা।
ইউক্রেনে হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর কয়েক দফা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এর প্রতিবাদে রাশিয়া জ্বালানি খাতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে রাশিয়া। বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ হয়ে নর্ডস্ট্রিম–১ গ্যাসের পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনের ছিদ্রের ঘটনা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাল্টিক পাইপলাইনের উদ্বোধনকে ছাপিয়ে গেছে। মস্কোর ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে এ পাইপলানের মাধ্যমে পোল্যান্ডে নরওয়েজিয়ান গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
নর্ডস্ট্রিম–২ পাইপলাইনের অপারেটর গত সোমবার রাতে হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কথা জানান। তখন এক মুখপাত্র বলেছিলেন পাইপলাইনে ছিদ্রের কারণে এমনটি হতে পারে।
ডেনমার্কের একটি জ্বালানি সরবরাহকারী সংস্থা এর আগেই এক বিবৃতিতে বলেছে, নর্ডস্ট্রিম–২ পাইপলাইনের একটিতে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। এর কয়েক ঘণ্টা পর নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনের এক অপারেটর বলেছেন, নর্ডস্ট্রিম–১ পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ার কারণ খুঁজছেন তাঁরা।
তবে এ বিষয়ে কারা তদন্ত করবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ডেনমার্কের জ্বলানি কর্তৃপক্ষের প্রধান ক্রিস্টোফার বোতজাউ বলেন, কারা তদন্ত করবে এ বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি।
কেউ এখনো পাইপলাইনের ছিদ্র দেখতে যায়নি। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী মাগদালিনা অ্যান্ডারসন বলেন, সুইডিশ সশস্ত্র বাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ ও সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। জার্মানি বলেছে, তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করছে।