সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও নিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী বিতর্কের মুখে পড়েছে। ওই ভিডিওগুলোয় দেখা গেছে, ইউক্রেনের সেনারা রুশ সেনাদের একটি দলকে বন্দী করার চেষ্টা করছেন। আত্মসমর্পণকারী ওই রুশ সেনাদের পরবর্তী সময়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, আত্মসমর্পণকারী রুশ সেনাদের হত্যা করে ইউক্রেনীয় বাহিনী কি যুদ্ধাপরাধ করেছে, নাকি আত্মরক্ষার্থে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে?
এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস ওই ভিডিওগুলোর সত্যতা পরীক্ষা করেছে। এর ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
গত সপ্তাহে সিরিজ ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে এ মাসের শুরুর দিকে হওয়া একটি গোলাগুলির ঘটনার আগের ও পরের দৃশ্য সংযোজন করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে কমপক্ষে ১১ জন রুশ সেনাকে দেখা গেছে। তাঁদের বেশির ভাগকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাঁদের খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম ভিডিওগুলো প্রকাশ করা হয়। ভিডিওগুলোর সত্যতা পরীক্ষা করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তবে কেন এবং ঠিক কীভাবে ওই রুশ সেনাদের হত্যা করা হলো, তা ভিডিওতে দেখা যায়নি।
এমন অবস্থায় এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ হবে কি না, তা নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক বিতর্ক চলছে।
এ ঘটনা নিয়ে মস্কো ও কিয়েভ দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করছে। রাশিয়া বলছে, যুদ্ধবন্দী নিরস্ত্র সেনাদের নির্দয়ভাবে গুলি করেছে ইউক্রেন। আর ইউক্রেনের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার দিমিত্র লুবিনেৎস বলেছেন, আত্মসমর্পণের সময় রুশ সেনাদের একজন ইউক্রেনীয় সেনাদের দিকে গুলি ছোড়ার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, এ ভিডিওগুলো নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের মুখপাত্র মার্তা হুরতাদো গত শুক্রবার রয়টার্সকে বলেন, ‘ভিডিও সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা এগুলো খতিয়ে দেখছি।’
মার্তা হুরতাদো আরও বলেন, ‘ও দ্য কুম্বার (hors de combat) অন্তর্ভুক্ত সেনাদের হত্যার যে অভিযোগ উঠেছে, তা দ্রুত, পুরোপুরি ও কার্যকরভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন এবং দোষী ব্যক্তিদের যে কাউকেই জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফরাসি শব্দ ‘ও দ্য কুম্বা’ বলতে রণবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সেনাদের বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ, নিরস্ত্র হয়ে পড়া, অচেতন হয়ে পড়া কিংবা অন্য কোনো কারণে আত্মরক্ষার সক্ষমতা হারানোর কারণে যাঁরা রণবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, তাঁদের ‘ও দ্য কুম্বা’ বলা হয়ে থাকে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইউক্রেনীয় সেনারা লুহানস্ক অঞ্চলের মাকিভকা গ্রামের পুনর্দখল নেওয়ার পর এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। ভিডিওগুলোকে উপগ্রহ চিত্রের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে গ্রামটির একটি খামারের ভেতরে ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে। কয়েকটি ভিডিও ১২ নভেম্বর ইউক্রেনপন্থী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত চারটি ভিডিও সিরিজের অংশ। ওই ভিডিওগুলো ড্রোনে ধারণ করা হয়েছিল। ওই গ্রামে সম্প্রতি ওপর থেকে ধারণকৃত অন্য ভিডিওগুলোরও সত্যতা পরীক্ষা করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, দুটি সূত্র ভিডিওগুলো ধারণ করেছে। মুঠোফোনে মাকিভকা যুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ধারণে নিয়োজিত এক ইউক্রেনীয় সেনা কিছু ভিডিও ধারণ করেছেন। তবে তাঁর নাম জানা যায়নি। আর শত্রুপক্ষের ওপর নজরদারিতে নিয়োজিত ইউক্রেনীয় সেনাদলটি ড্রোন ভিডিওগুলো ধারণ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস আরও বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো একই এলাকায় ধারণ করা হয়েছে। ওই ভিডিওতে কী দেখা যাচ্ছে, সেগুলোও সংবাদমাধ্যমটি বিশ্লেষণ করেছে।
প্রথম ভিডিওতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিও ডায়েরির মতো মিউজিক দিয়ে তৈরি করা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনীয় সেনারা মাঠে শুয়ে দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে গুলি ছুড়ছেন। সেনারা ইউক্রেনীয় ও রুশ—দুই ভাষাতেই কথা বলছিলেন।
ভিডিওতে বন্দুকের শব্দ শোনা গেছে। ফুটেজে আলোকচিত্রীর চেহারা দেখা যাচ্ছে। তবে ওই ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখতে নিউইয়র্ক টাইমস ভিডিওর অংশবিশেষ ঝাপসা করে দিয়েছে।
দ্বিতীয় ভিডিওতে একটি খামারের আঙিনায় ইউক্রেনীয় সেনাদের একই দলটিকে দেখা গেছে। এটিও আকাশ থেকে ধারণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, লড়াইয়ের কারণে ওই খামারবাড়ি ও আশপাশের ভবনগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই এলাকার অন্য অনেক ভবনেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। এ ভিডিওতে দেখা গেছে, খামারবাড়ি প্রাঙ্গণের ভবনগুলোর একটিতে তাক করে থাকা মেশিনগানমুখী হয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে অবস্থান নিয়েছেন এক ইউক্রেনীয় সেনা। তাঁর পেছনে অপর এক ইউক্রেনীয় সেনা দাঁড়িয়ে আছেন। তৃতীয় ইউক্রেনীয় সেনাকে হাতে রাইফেল নিয়ে সেখানে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাচ্ছে। অপর এক ইউক্রেনীয় সেনাকে দেখা যাচ্ছে, মাটিতে পড়ে থাকা একটি দেহকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছেন। এটি একজন রুশ সেনার মরদেহ বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশেই পড়ে ছিল আরেকজনের দেহ। এটি নড়াচড়া করছিল না। এটিও রুশ সেনার মরদেহ বলে মনে করা হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আরও কয়েকজন রুশ সেনা ওই খামারবাড়ি প্রাঙ্গণের একটি ভবনে ছিলেন। তবে ওই ভিডিওতে তাঁদের দেখা যাচ্ছিল না।
তৃতীয় ভিডিওটি মুঠোফোনে ধারণ করা হয়েছে। এটিও ওই খামারবাড়ি প্রাঙ্গণেই ধারণ করা। ভিডিওটির কিছু কিছু জায়গা ফাঁকা। তবে কেন এমন হলো, তার কারণ জানা যায়নি। ওই ভিডিওতে চারজন ইউক্রেনীয় সেনাকে দেখা গেছে। এর মধ্যে তিনজনের কাছেই অস্ত্র ছিল।
এ জায়গায় এসে ভিডিওটি কেটে গেছে। এরপর যখন এটি আবারও শুরু হয়, তখন দেখা যাচ্ছে, রুশ সেনারা উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে আছেন। তাঁদের মধ্য অন্তত দুজন জীবিত; তাঁদের ভিডিওতে নড়াচড়া করতে দেখা গেছে। তবে অন্যদের নড়াচড়া ছিল না। ভিডিওতে দেখা গেছে, একে একে আরও চার সেনা ধীরে ধীরে খামারবাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তুলে বের হয়েছেন।
সেখান দুজন ইউক্রেনীয় সেনা তাঁদের বন্দুকের নল নিচের দিকে তাক করা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের দেখে নির্ভার মনে হচ্ছিল। শুরুতে এই রুশ সেনাদের ধরার প্রক্রিয়াটি শৃঙ্খলার সঙ্গে চলছিল। তবে হঠাৎই সবকিছু পাল্টে যায়। ১১তম রুশ সেনা যখন ভবন থেকে বের হয়ে আসছিলেন, তখনই এর সূত্রপাত। এ সেনা বের হওয়ার সময় এক ইউক্রেনীয় সেনাকে গুলি করে দেন। এতে ইউক্রেনীয় সেনারা হতভম্ব হয়ে পড়েন। যে মুঠোফোনে ভিডিও দৃশ্যটি ধারণ করা হচ্ছিল, সেটিও তখন কেঁপে ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, এরপর কী ঘটেছে, তা জানতে ভিডিওটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছে তারা। এতে দেখা গেছে, ওই রুশ সেনার পাশে যে ইউক্রেনীয় সেনা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিও তাঁর বন্দুক উঁচু করে রুশ সেনার দিকে তাক করেছেন।
এখানে ভিডিওটি শেষ হয়ে গেছে। এরপর কী ঘটেছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে ওই এলাকার আরেকটি ভিডিওতে রক্তাক্ত পরিস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে দেখা গেছে রুশ সেনারা মাটিতে পড়ে আছেন। তাঁদের নড়াচড়া নেই। দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা মৃত। আশপাশে রক্ত বয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগকে দেখা গেছে তাঁরা যে জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন, সেখানেই পড়ে আছেন। আত্মসমর্পণের আগে রুশ সেনাদের গায়ে যে পোশাক ছিল, মরদেহগুলোর গায়েও একই পোশাক।
আর যে রুশ সেনা আত্মসমর্পণকালে গুলি করেছিলেন, তাঁকে তাৎক্ষণিক হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই জায়গাতেই তাঁর দেহ পড়ে আছে। তিনি যে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের চিকিৎসাবিষয়ক উপদেষ্টা রোহিণী হার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউক্রেন যদি আন্তর্জাতিক রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হয়ে থাকে, তবে এ ঘটনার জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, কোনো যোদ্ধা যদি তাঁর অস্ত্র সমর্পণ করেন অথবা তাঁর কাছে যদি আত্মরক্ষা করার মতো কোনো অবলম্বন না থাকে, তিনি আত্মসমর্পণকারী বলে বিবেচিত হন, তাহলে তাঁকে হত্যা কিংবা আঘাত করাটা আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত আইনের লঙ্ঘন।
তবে নেদারল্যান্ডসের ইয়ুৎরেকত বিশ্ববিদ্যালয়ের যুদ্ধাপরাধের বিচারসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ইভা ভুকুসিক বলেন, এখানে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে কি না, তা শুধু ভিডিও প্রমাণের ভিত্তিতে বলাটা কঠিন। রুশ সেনাদের কোন সময় গুলি করা হয়েছে, তা এখানে জরুরি।
ভুকুসিকের মতে, শেষ রুশ সেনা বের হয়ে ইউক্রেনীয় সেনাকে গুলি করার সময় কিংবা এর পরপরই ইউক্রেনীয়রা ঘটনার আকস্মিকতায় গুলি ছুড়েছেন, নাকি তাঁরা প্রতিশোধ নিতে অপর সেনাদের গুলি করেছেন, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটি যুদ্ধাপরাধ কি না। তাঁরা যদি প্রতিশোধমূলক গুলি ছোড়েন, তাহলে তা যুদ্ধাপরাধ হবে। তবে আকস্মিক উত্তেজনার মধ্যে তাঁরা যদি গুলি করে থাকেন, তাহলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবেন না। কারণ, আত্মসমর্পণকারী ওই রুশ সেনাদের তখনো তল্লাশি করা হয়নি। তাদের কাছে অস্ত্র আছে কি না, তা ইউক্রেনীয় সেনারা জানতেন না।
গত মাসে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলেছিলেন, ইউক্রেনে রুশ সেনারা বেসামরিক ও সামরিক বন্দীদের নির্যাতন করছেন। তদন্তকারীরা আরও বলেছেন, ইউক্রেনীয় সেনারাও যুদ্ধবন্দীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। তবে রাশিয়ার তুলনায় তাঁদের নির্যাতনের মাত্রা কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাশিয়ার মানবাধিকার পরিষদ বলছে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ভিডিওগুলো পাঠাবে। দেশটির তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।