ইউরোপে এত গরম পড়ছে কেন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে
 ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে। কোনো কোনো দেশে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, উষ্ণতম সপ্তাহ দিয়েই শুরু হয়েছে চলতি মাস।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনোর (প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে) প্রভাবে গরম চরমে উঠেছে। এ কারণে গত জুনে রেকর্ড মাত্রায় উষ্ণতা ছিল। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে গরম বাতাস বয়ে যাওয়ায় ইউরোপে উষ্ণতম আবহাওয়া বিরাজ আছে।

ইউরোপে এত গরম কেন

১০ জুলাই থেকে দক্ষিণাঞ্চলে সেরবেরাস নামের উচ্চচাপের অ্যান্টিসাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। এরপর চ্যারন নামের আরেকটি উচ্চচাপ তৈরি হয়েছে। এমন আবহাওয়ার কারণে গ্রিস, স্পেন ও ইতালিতে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা হবে রেকর্ড।

গত বুধবার ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টস বলেছে, জুনের শুরুতে আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট তাপপ্রবাহও ইউরোপের বর্তমান গরম আবহাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের বেশির ভাগ অববাহিকা অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে তাপমাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সামুদ্রিক দাবদাহের কারণে বায়ুমণ্ডলের ওপর প্রভাব পড়ছে এবং সমুদ্র এলাকার বাতাস গরম হয়ে ওঠছে।

জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, তা জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন তীব্র ও বিপজ্জনক দাবদাহ দেখা দিচ্ছে।

রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক সায়েন্সের বিজ্ঞানী অক্ষয় দেওরাস আল–জাজিরাকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দাবদাহের মাত্রা, তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। এতে গরম তীব্র দাবদাহে রূপ নিচ্ছে।

অ্যান্টিসাইক্লোন কী

সাইক্লোনের কারণে ঝোড়ো আবহাওয়া দেখা দেয়। আর অ্যান্টিসাইক্লোন হচ্ছে বিপরীত অবস্থা। এটি হলো উচ্চচাপের অঞ্চল, যেখানে বাতাসের গতি অপেক্ষাকৃত ধীর থাকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত পরিচ্ছন্ন, উষ্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতি থাকে। তবে তা কখনো কখনো তীব্র রূপ নিতে পারে।

রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক সায়েন্সের বিজ্ঞানী অক্ষয় দেওরাস বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে যদি উচ্চচাপ অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং তা কয়েক দিনের মধ্যে কেটে যায়, তাহলে খুব একটা গরম পড়বে না। কারণ, এটি ক্ষণস্থায়ী অবস্থা। তবে এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গত সপ্তাহে এমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর আফ্রিকায় সৃষ্ট উচ্চচাপটি দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপে অবস্থান নেয়। এরপর এটি সরে যায়। চলতি সপ্তাহে আবারও একটি উচ্চচাপ তৈরি হয়েছে। নতুন এ দাবদাহের নাম দেওয়া হয়েছে চ্যারন।’

কেমন গরম অনুভূত হচ্ছে, এক বিবৃতিতে তার বর্ণনা দিয়েছেন রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ুবিজ্ঞানী হান্না ক্লোক। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপের ওপর দিয়ে যে গরম বাতাস বয়ে যাচ্ছে, তাতে ইতালি ও আশপাশের দেশগুলো যেন এক বিশাল পিৎজা ওভেনে পরিণত হয়েছে।

বিবৃতিতে ক্লোক আরও বলেন, আফ্রিকা থেকে আসা গরম বাতাস এখন উচ্চচাপ অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, উষ্ণ সাগরে, ভূমিতে ও বাতাসে এমন গরম অবস্থা চলতে থাকবে।

কোন দেশগুলোর ওপর বেশি প্রভাব পড়ছে

তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী দেশ হচ্ছে গ্রিস, ইতালি ও স্পেন। ফ্রান্স, জার্মানি ও পোল্যান্ডের কিছু জায়গায় বড় ধরনের দাবদাহ দেখা দিয়েছে।

দাবদাহ কত দিন থাকবে

ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টস আভাস দিয়েছিল, বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) নাগাদ এ চরম গরম অবস্থা কেটে যাবে। তবে এ স্বস্তিদায়ক অবস্থা বেশি সময় স্থায়ী হবে না। কারণ, আগামী রোববার থেকে আবার চরম গরম অবস্থা শুরু হতে পারে। আর এমন অবস্থা থাকবে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত। ইউরোপকে আরও কয়েকটি তীব্র গরমের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে বলেও আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপে কী হতে পারে

আগামী কয়েক দিনে গ্রিসের তাপমাত্রা ৪১-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১০৫-১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছাতে পারে। দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলেছে, অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে অ্যাথেন্সের অ্যাক্রোপলিসসহ সব প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনের স্থানগুলো দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। আগামী রোববার পর্যন্ত এ নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।

ইতালির মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আভাস দেওয়া হয়েছে। সারদিনিয়ায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এবং পালেরমোতে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ওঠার আভাস দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় উচ্চচাপ অবস্থা চ্যারন দুর্বল হয়ে পড়বে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। আর তাতে সেখানে গরম কমে যাবে।

স্পেনের কিছু এলাকায়ও খানিকটা স্বস্তি মিলতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় স্পেনে ঝড়ের আভাস দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে প্রচণ্ড দমকা বাতাস বয়ে যেতে পারে। অবশ্য, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সেভিল ও কর্দোভাতে রোববার তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।

জুলাই উষ্ণ মাস হওয়ার আশঙ্কা
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার শীর্ষস্থানীয় জলবায়ুবিজ্ঞানী গ্যাভিন স্মিট বলেছেন, চলতি বছরের জুলাই মাসটি কয়েক শ বছরের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হতে পারে। গত বৃহস্পতিবার নাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন আভাস দেন।

গ্যাভিন স্মিট বলেন, এখন যা ঘটছে, তাতে ২০২৩ সালটি উষ্ণতম বছর হিসেবে নাম লেখাতে পারে। এল নিনোর কারণে ২০২৪ সাল আরও বেশি উষ্ণ হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন তিনি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, জুলাই মাস প্রতিদিনই উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করছে। স্থলভাগ ও কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন দাবি করা হয়েছে।