বিশ্লেষণ

পুতিন কি তাঁর ভাবমূর্তি ফেরাতে পারবেন

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভাবমূর্তি-সংকটে পড়েছেন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভাবমূর্তি-সংকটে পড়েছেন

ক্রেমলিনের নতুন প্রকল্প—রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার।

ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ভাগনারের অভূতপূর্ব বিদ্রোহের পর দেশে-বিদেশে সন্দেহ-সংশয়-ভ্রুকুটির মুখে ক্রেমলিন তড়িঘড়ি করে নতুন এ মিশনে নামতে বাধ্য হয়।

ক্ষতি কতটা হয়েছে, ক্ষত কতটা গভীর, তা বোঝা যায়, পুতিনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে আদাজল খেয়ে ক্রেমলিনের মাঠে নেমে পড়ার ঘটনায়।

রাশিয়ায় গত ২৩-২৪ জুন ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বে ২৪ ঘণ্টার বিদ্রোহের পর ‘বিরল’ সব ঘটনা ঘটতে দেখছে রাশিয়া। এসব ঘটনার বেশির ভাগজুড়েই আছে প্রচারণা। আরও স্পষ্ট করে বললে, ক্রেমলিনপ্রধানের ভাবমূর্তির ক্ষত সারানোর অবিরাম প্রচেষ্টা।

চলুন, একটু চোখ ফেরানো যাক পুতিনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ক্রেমলিনের নানামুখী প্রচেষ্টার দিকে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ভাগনারের বিদ্রোহ থেমে যাওয়ার পরের দিনগুলোতে পুতিনের অস্বাভাবিক কর্মতৎপরতা চোখে পড়ে। তিনি হুট করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন, জ্যেষ্ঠ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন, সেনা সমাবেশে হাজির হচ্ছেন, এমনকি সাধারণ জনতার মধ্যেও তাঁর সরব উপস্থিতি দেখা যায়।

পুতিনের এসব কার্যক্রম রুশ গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, রুশ জনগণ তো বটেই, বিশ্বকে (বিশেষ করে পশ্চিমাদের) বোঝানো, দেখানো—বিদ্রোহে মোটেই টলেননি পুতিন। রাশিয়ার ওপর তাঁর পূর্ণ ও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ঠিক আগের মতোই।

এই যেমন ২৬ জুন হুট করে ঘোষণা আসে, রুশ প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এদিন রাত ১০টার দিকে পুতিন টিভির পর্দায় হাজির হন। রাতের এমন সময়ে পুতিনের জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ব্যাপারকে কেউ স্বাভাবিক হিসেবে নেয়নি। তবে পুতিনের মাত্র পাঁচ মিনিটের ভাষণে আহামরি কিছু ছিল না। তিনি ঐক্যবদ্ধ রাশিয়ার কথা বলেন। পুতিনের ভাষায়, এই রুশ নাগরিকেরা সম্মিলিতভাবে ভাগনারের বিদ্রোহ ঠেকিয়ে দিয়েছেন। তিনি ভাগনারের নিয়মিত যোদ্ধাদের প্রশংসা করেন। তাঁদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলে অভিহিত করেন। জনগণ, সেনাবাহিনী, ভাগনারের সাধারণ যোদ্ধাসহ সব পক্ষের প্রশংসা করে তিনি পুরো পরিস্থিতি নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি তিনি নিজেকে ত্রাতা হিসেবে তুলে ধরেন, যার বদৌলতে রাশিয়া বড় ধরনের রক্তপাত এড়াতে পেরেছে। পুতিন এমন দাবি করলেও বাস্তবে ভাগনারের বিদ্রোহকালে রক্তপাত হয়েছে।

প্রায় ২৩ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন ভ্লাদিমির পুতিন

পুতিনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার-প্রচেষ্টায় আরও গতি আসে ২৭ জুন। এদিন তিনি ক্রেমলিনের ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে হাজারো সেনার সমাবেশে বীরদর্পে হাজির হন। এই সামরিক সমাবেশে সেনাদের পাশাপাশি রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ড ও ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্যরা ছিলেন। লাল কার্পেট মাড়িয়ে পুতিন যেভাবে এই অনুষ্ঠানে হাজির হন, তা সবাইকে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, তিনিই রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর পেছনে ছিল রাশিয়ার জাতীয় পতাকা ও বেয়োনেট হাতে কয়েক রুশ সেনা। এ দৃশ্যের যে প্রতীকী অর্থ রয়েছে, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ভাগনারের বিদ্রোহকালে রুশ সেনারা আনুগত্যের যে প্রমাণ রেখেছেন, সে কথা স্মরণ করেন পুতিন। তিনি কথায়, অঙ্গভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেন, পুরো রাশিয়া তাঁর পেছনেই আছে। পুতিনের সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে বেজে ওঠে রাশিয়ার জাতীয় সংগীত। দেওয়া হয় গান স্যালুট। ক্রেমলিনের প্রচেষ্টায় মনে হয়, তারা চাইছে, এই জাতীয় সংগীত, এই গান স্যালুটের আওয়াজ প্রত্যেক রুশ নাগরিকের কানে পৌঁছে যাক। ছাড়িয়ে যাক সারা বিশ্বে, বিশেষ করে পুতিন-বিরোধীদের কর্ণকুহরে।

২৮ জুন আরেক বিস্ময়কর ঘটনা দেখা গেল। দাগেস্তানে সাধারণ জনতার মাঝে হাজির হন পুতিন। অথচ করোনার শুরু থেকে পুতিন সবার সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন। এমনকি তিনি বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও এই নিয়ম অনুসরণ করে আসছিলেন। তবে পরিস্থিতি পুতিনকে যে তাঁর নিয়ম বদলাতে বাধ্য করেছে, তা অনুমেয়। তিনি দাগেস্তানে গিয়ে জনতার সঙ্গে একেবারে মিশে যান। জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি শিশুদের চুমো খান। কাউকে আলিঙ্গন করেন, কারও সঙ্গে হাত মেলান। পোজ দিয়ে ছবিও তোলেন। ‘অমাবস্যার চাঁদের’ দেখা পেয়ে রুশ জনতাকে উল্লাস-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। এই দৃশ্য রুশ টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বোঝানো হয়, সমালোচকদের ধারণা ভুল। পুতিন আগের মতোই তাঁর দেশে জনপ্রিয়।

ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন

গত ২৯ জুন রুশ প্রেসিডেন্ট মস্কোয় রাশিয়ার একটি ব্যবসায়িক কনফারেন্সে যোগ দেন। সেখানেও দেশের ওপর তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকা, তাঁর প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার প্রদর্শনী চলে। অনুষ্ঠানে পুতিনকে দাঁড়িয়ে সম্মান (স্ট্যান্ডিং ওভেশন) দেখানো হয়। একই অনুষ্ঠানে পুতিনকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, দক্ষ শিল্পীর মতো লাল কালি দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখের একটি কার্টুন আঁকতে দেখা যায়। যেন তিনি নির্ভার, রাশিয়ায় কিছুই ঘটেনি!

ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে ক্রেমলিন দেখানোর চেষ্টা করছে, এটা পুতিনের রাশিয়া। রাশিয়ার সর্বত্র তাঁর সরব উপস্থিতি আছে। রাশিয়ার শতভাগ কর্তৃত্ব তাঁর হাতেই রয়েছে।

তবে পুতিনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ক্রেমলিনের নিরন্তর প্রচেষ্টা সেই সত্যকে চাপা দিতে পারে না যে ভাগনারের বিদ্রোহ পুতিনকে হতবাক করে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ ছিল পুতিনের জন্য একটা বড় হুমকি, তাঁর শাসন-কর্তৃত্বের প্রতি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ।

ভাগনারের বিদ্রোহকালে আমরা এমন এক পুতিনকে দেখি, যিনি তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যে একা একটা মানুষ। বিদ্রোহের দিন পুতিন জাতির উদ্দেশে জরুরি ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে ভাগনারপ্রধানের নাম মুখে না নিয়ে অঙ্গীকার করেছিলেন, রাশিয়ার পিঠে ছুরি মারার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের মুখে শোনা গেল, পুরোপুরি ভিন্ন সুর। তিনি জানান, ভাগনারপ্রধানের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগ আনা হবে না। তিনি বেলারুশে নির্বাসনে যাবেন। আর ভাগনারের বিদ্রোহী যোদ্ধাদেরও নিরাপদে পিছু হটতে দেওয়া হবে।

ভাগনারের বিদ্রোহের পর এক অনুষ্ঠানে কার্টুন আঁকছেন ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় এই সমঝোতাকে রক্তপাত এড়ানোর একটি মহৎ কর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু পুতিনের কট্টর অনুগতদের মধ্যেও কেউ কেউ তাঁর এই আকস্মিক ‘ইউ-টার্ন’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেননা, পুতিনের এমন নমনীয় আচরণ আগে কখনো দেখা যায়নি।

২০১৫ সালে পুতিন বলেছিলেন, তাঁর জন্মস্থান লেনিনগ্রাদের পথঘাট তাঁকে একটি বিষয় শিখিয়েছে। আর তা হলো লড়াই অনিবার্য হলে প্রথমেই আঘাত হানো। কিন্তু ভাগনারের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এক অপরিচিত পুতিনকে দেখা গেল।

ভাগনারের বিদ্রোহের আগপর্যন্ত দেশে-বিদেশে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একজন রাষ্ট্রনেতার ভাবমূর্তি উপভোগ করে আসছিলেন, যিনি তাঁর শত্রুকে শুরুতেই বিনাশ করেন।

পুতিন অন্তত এক দিন আগে ভাগনারের বিদ্রোহের বিষয়ে তথ্য পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তিনি বিদ্রোহ রুখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি।

বিদ্রোহের সূত্রপাত হলে তা দমনে পুতিন কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। কিন্তু পুতিনের হুঁশিয়ারি কোনো কাজে আসেনি। সমঝোতার আগপর্যন্ত ভাগনারের বিদ্রোহী যোদ্ধারা মস্কো অভিমুখী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন। এমনকি অগ্রযাত্রা চলাকালে তাঁরা রুশ বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ ভূপাতিত করেন। এতে বেশ কিছু বৈমানিক নিহত হন।

বিদ্রোহ চলাকালে পুতিনের অবস্থান নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুতিন হয়তো ভয় পেয়ে কোনো গোপন স্থানে লুকিয়েছেন।

ক্রেমলিনে সেনাদের জমায়েতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

ভাগনারের বিদ্রোহ দমনে পুতিনের হুংকার কার্যত শূন্য বলে প্রমাণিত হয়। কারণ, তাঁর আদেশ বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়ার সামরিক বাহিনীসহ কোনো কর্তৃপক্ষই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে মনে হচ্ছিল, পুতিন যেন একটি কাল্পনিক রুশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বাস্তবে যাঁদের উপস্থিতি নেই।

সব মিলিয়ে রুশ নাগরিকেরা প্রথমবারের মতো পুতিনকে একা, অসহায়, দুর্বল নেতা হিসেবে দেখতে পান। যাঁর আদেশ পালন করার জন্য কেউ মাঠে নেই। সবাই যেন একটি পরিণতি দেখার অপেক্ষায় আছেন।

ভাগনার বিদ্রোহের ফলে সৃষ্ট এই পরিস্থিতির জন্য অবশ্য অনেকে পুতিনকেই দায়ী করেন। কারণ, প্রিগোশিন নামের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে তো তিনি নিজ হাতেই তৈরি করেছেন। তাঁকে নিজের স্বার্থে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছেন।

ভাগনারের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে পুতিনের ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রনেতার ভাবমূর্তি যে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, তা বলার অবকাশ রাখে না। এখন পুতিন যা বলছেন, যা করছেন, তাতে তাঁকে নিয়ে, তাঁর কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিয়ে রুশ নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হওয়া সন্দেহ-উদ্বেগ দূর করতে পারেনি।

ভাগনারের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে পুতিনের ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রনেতার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে

খোদ ক্রেমলিনের লোকজনই বিশ্বাস করছেন না যে রাশিয়ার ওপর পুতিনের এখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। রাশিয়ার অভিজাত (এলিট) শ্রেণির অনেক লোকের মনোভাবও একই, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ সুযোগে পুতিনবিরোধীরা এখন উৎফুল্ল, উদ্বুদ্ধ। তাঁরা বলছেন, পুতিনের পতনের সময় গণনা শুরু হয়ে গেছে।

প্রায় ২৩ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় আছেন পুতিন। এই সময়কালে ক্রেমলিন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে পুতিনের লৌহমানব, শক্তিশালী, স্থিতিশীল শাসকের একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। ভাবমূর্তি তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয়। এতে অনেক সময় লাগে। তবে ভাবমূর্তি নষ্ট হতে একটা ঘটনাই যথেষ্ট। পুতিনের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই ঘটেছে। সৃষ্ট ক্ষতে হয়তো প্রলেপ লাগানো যাবে, কিন্তু পুতিনের ভাবমূর্তি আর কখনোই পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা যাবে বলে মনে হয় না। ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে।