সময়টা ২০১৯ সাল, শীতকাল। ইতালির নৈশক্লাবগুলো থেকে বাজনার তালে তালে ভেসে আসছিল—‘আমি জর্জিয়া, আমি একজন নারী, আমি একজন মা, আমি একজন ইতালীয়, আমি একজন খ্রিষ্টান।’ বক্তব্যটি ছিল জর্জিয়া মেলোনির। তাঁর এই বক্তব্য অনেকেরই নজর কেড়েছিল।
মেলোনি ইতালির রাজনৈতিক দল ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়ার (ব্রাদার্স অব ইতালি) নেতা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি যখন ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন, তখন তাঁর কট্টর ডানপন্থী দলটি বেশ ছোট ছিল। বক্তব্যটি নৈশক্লাবগুলোতে বারবার বাজানো হচ্ছিল মেলোনিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার জন্য।
জর্জিয়া মেলোনির জন্ম ১৯৭৭ সালে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ইতালির রাজনৈতিক দল মোভিমেন্তো সোশিয়ালে ইতালিয়ানোর (এমএসআই) তরুণদের সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দলটি গড়ে তুলেছিলেন ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির অনুসারীরা। এই সংগঠনকে তাঁর ‘দ্বিতীয় পরিবার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন মেলোনি।
তবে দিন বদলেছে। মেলোনির অতিরক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী আচরণ তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। দেশটিতে গত রোববার জাতীয় নির্বাচনেও এর আঁচ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত হিসাব–নিকাশ বলছে, ৪৫ বছর বয়সী জর্জিয়া মেলোনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতালির হাল ধরতে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালে তাঁর দলের প্রতি জনসমর্থন যেখানে ৪ শতাংশ ছিল, সেখানে তা বেড়ে নির্বাচনের আগে ২৫ শতাংশ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তাঁর আপসহীন মনোভাব নেতৃত্ব নিয়ে দৃশ্যত হতাশ ইতালীয়দের মধ্যে নতুন জায়গা করে নিয়েছে। গত ১১ বছরে সাতটি সরকার দেখেছে ইতালির জনগণ। বর্তমান নেতাদের মধ্যে মেলোনিই একমাত্র আছেন, যিনি এখনো দায়িত্বে এসে জনগণের পরীক্ষায় পড়েননি।
ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন জানাননি মেলোনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিরোধীদের কাতারে দাঁড়ানোর। তাঁর জোটের শরিক দল লিগ পার্টির নেতা মাত্তেও সালভানি ও ফোরজা ইতালিয়ার নেতা সিলভিও বেরলুসকোনি কিন্তু সরকারকে সমর্থনের পথেই হেঁটেছিলেন। পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, সরকারের সঙ্গে হাত না মেলানোই মেলোনিকে বড় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
কে এই জর্জিয়া মেলোনি, রাজনৈতিক অঙ্গনে কীভাবে তাঁর জনপ্রিয়তার চূড়ায় ওঠা, আর কোন পথে হেঁটে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন—তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে।
২০১২ সালে রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেন তিনি—ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়ার প্রতিষ্ঠা। জাতীয়তাবাদ, রক্ষণশীলতা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে সংশয়ের আদর্শে গড়ে ওঠে ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়া। আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার, অভিবাসী ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে খোলাখুলিভাবে অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে দলটি।
পথচলা শুরু
জর্জিয়া মেলোনির জন্ম ১৯৭৭ সালে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ইতালির রাজনৈতিক দল মোভিমেন্তো সোশিয়ালে ইতালিয়ানোর (এমএসআই) তরুণদের সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দলটি গড়ে তুলেছিলেন ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির অনুসারীরা। এই সংগঠনকে তাঁর ‘দ্বিতীয় পরিবার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন মেলোনি।
মেলোনির যখন জন্ম হয়, তখন তাঁর মায়ের বয়স ছিল ২৩ বছর। এর মাত্র দেড় বছর আগেই মেলোনির বড় বোন আরিয়ানা পৃথিবীতে এসেছিল। সংসারের খরচ মেটাতে নানা ধরনের পেশার সঙ্গে জড়িয়েছিলেন মেলোনির মা। কিশোরী বয়সেই একই পথে হেঁটেছিলেন মেলোনি। পানশালার কর্মী থেকে বাচ্চাদের দেখভাল—অনেক কিছুই করতে হয় তাঁকে।
মেলোনির বাবা ছিলেন ইতালির রাজধানী রোমের উত্তরাঞ্চলের ধনী এলাকার বাসিন্দা। পেশায় একজন হিসাবরক্ষক। মেলোনির শৈশবেই তিনি তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে বসবাস শুরু করেন। মেলোনিদের দেখতে অবশ্য মাঝেমধ্যে আসতেন। তবে ১১ বছর বয়সে মেলোনি সিদ্ধান্ত নেন, বাবার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবেন না।
মেলোনিকে নিয়ে ইতালির আবরুজো অঞ্চলে ব্রাদার্স অব ইতালির গভর্নর মার্কো মার্সিলিও বলেন, ‘কোনো কিছু পেতে হলে কীভাবে লড়াই করতে হয়, তা তিনি ছোটবেলা থেকেই শিখেছেন। এটাই তাঁর চরিত্র গঠন করেছে।’
রাজনীতিতে সক্রিয়
মেলোনি যখন এমএসআইয়ে তরুণদের সংগঠনের নেতা, তখন ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বামপন্থী রাজনৈতিক সংস্কৃতির আধিপত্য ছিল। সেখানে একমাত্র ডানপন্থী সংগঠন হিসেবে সক্রিয় ছিল এমএসআইয়ের ছাত্রসংগঠন। এই সংগঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন মেলোনি।
ফ্যাসিবাদী পরিচয় পেছনে ফেলতে ১৯৯৫ সালে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এএন) নাম নেয় এমএসআই। এএনকে রক্ষণশীল ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে পরিচিত করা হয়। এর কয়েক বছরের মাথায় মেলোনি এএনের তরুণদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হন। আর মাত্র ২৯ বছর বয়সে ইতালির পার্লামেন্টে পা রাখেন তিনি।
একই সময়ে মধ্যম ডানপন্থী দল ফোরজা ইতালিয়া গঠন করেন বেরলুসকোনি। এএনের সঙ্গে জোট গড়ে ফোরজা ইতালিয়া। পরে এই জোট ইতালিতে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন বেরলুসকোনি। ওই সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে ইতালির সর্বকনিষ্ঠ যুববিষয়ক মন্ত্রী হন মেলোনি।
এরপর ২০১২ সালে রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেন তিনি—ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়ার প্রতিষ্ঠা। জাতীয়তাবাদ, রক্ষণশীলতা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে সংশয়ের আদর্শে গড়ে ওঠে ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়া। আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার, অভিবাসী ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে খোলাখুলিভাবে অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে দলটি।
‘ঈশ্বর, পরিবার ও স্বদেশ’
এদওয়ার্দো নোভেলি একজন সমাজবিজ্ঞানী ও রোম থ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি বলেন, মেলোনির যে দর্শন সেটি ‘ঈশ্বর, পরিবার ও স্বদেশ’ নীতিকে অনুসরণ করে। এই নীতির ভিত্তি খ্রিষ্টান পরিচয়, ঐতিহ্যগত পারিবারিক কাঠামো এবং ইতালীয় দেশপ্রেমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি জাতি।
মেলোনির এই দর্শন ইতালির নাগরিকদের দুই ভাগে ভাগ করবে বলে মনে করেন এদওয়ার্দো নোভেলি। তাঁর ভাষ্যমতে, মেলোনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর এই দর্শনের প্রভাব আসবে ইতালির আইন, সরকারি কর্মকাণ্ড ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
ইতালিতে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল, মেলোনির জয়ের সম্ভাবনা ততই পোক্ত হচ্ছিল। তিনি ও তাঁর জোট ইউরোপের স্থিতিশীলতার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবেন না, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বোঝানোর জন্য এরই মধ্যে তাঁকে নমনীয় আচরণ করতে হয়েছে। এর কারণও অবশ্য আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা তহবিল থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে ইতালি।
শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নই নয়, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিও বারবার আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেলোনি। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হয়েছে চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাবে তাঁর দল।
রোমের লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক লরেঞ্জো কাস্তেলানি বলেন, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সুর বেশ নরম করেছেন মেলোনি। আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তাঁর যে অবিশ্বাস ছিল, সেদিক দিয়েও নরম হয়েছেন।
একটি শক্তিশালী দল হিসেবে সরকারে আসতেই নিজের আচরণে বেশ সাবধানতার সঙ্গে পরিবর্তন এনেছেন তিনি।
‘সবই লোকদেখানো’
সমালোচকেরা বলছেন, মেলোনির এই সুরবদল শুধুই লোক দেখানোর জন্য। ইতালির ইউনিভার্সিটি অব বোলোনিয়ার অধ্যাপক পিয়েরো ইগনাজি বলেছেন, ‘কোনো পরিবর্তন আসেনি। ইতালির ডানপন্থী রাজনীতির যে চরিত্র, তা নতুনভাবে দেখা যাচ্ছে। আর নব্য–ফ্যাসিবাদকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।’ তাঁর ভাষ্যমতে, মেলোনির সুরে যে পরিবর্তন, সেখানে ছদ্মবেশ রয়েছে।
এমন ধারণার কারণও আছে। নির্বাচনের আগেই সম্প্রতি এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভালো সময় শেষ হয়েছে। সেখানে সমালোচনা করেন গণহারে অভিবাসনের। নাগরিক স্বাধীনতার ওপর হাঙ্গেরির বিধিনিষেধের নিন্দা জানিয়ে গত শুক্রবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিবেদনেও সমর্থন জানায়নি তাঁর দল।
ইতালির সংবিধানে একটি পরিবর্তন আনতে মেলোনির রাজনৈতিক জোটের প্রস্তাবের সমালোচনাও হচ্ছে। ওই পরিবর্তন এলে দেশটিতে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পথ খুলে যাবে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট–শাসিত সরকারব্যবস্থার কাছাকাছি চলে যাবে ইতালির সংসদীয় গণতন্ত্র। তবে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে দেশটির বামধারার রাজনীতিকদের আপত্তি রয়েছে।