রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক এম-১ আব্রামস ট্যাংক দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ট্যাংকে ব্যবহারের জন্য ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ গোলা দেওয়ার কথাও জানিয়েছে মার্কিন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে মস্কো।
মস্কোর নিন্দা জানানোর কারণ আছে। ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন অনেকেই। এই ইউরেনিয়ামের তৈরি গোলাগুলোও বেশ শক্তিশালী। বর্তমানে প্রচলিত যেসব ট্যাংক আছে, সেগুলোর সুরক্ষা বর্ম ভেদ করতে পারে এগুলো।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। এ জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রয়োজন পড়ে। এই সমৃদ্ধকরণের প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম পারমাণবিক বিক্রিয়া করতে পারে না। এগুলো প্রকৃতি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় নয়। এরপরও ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামে কিছুটা তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকে।
ইউরেনিয়ামের ঘনত্ব খুবই বেশি। তাই ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ট্যাংক-মর্টারের গোলা ও বন্দুকের গুলির অগ্রভাগে স্থাপন করা হয়। এতে করে সেগুলোর লক্ষ্যবস্তু ভেদ করার সক্ষমতা বাড়ে। লক্ষ্যবস্তুর সংস্পর্শে এসে আগুনও ধরিয়ে দেয় এই ইউরেনিয়ামের তৈরি গোলা।
গোলার পাশাপাশি ট্যাংকের সুরক্ষা বর্মকে শক্তিশালী করতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত শতকের সত্তরের দশকে এই ইউরেনিয়াম দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি অস্ত্র প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। পরে ১৯৯৯ সালে কসোভো এবং ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কর্তৃপক্ষের (আইএইএ) তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম ‘রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় বিষক্রিয়া’ ঘটায়। তবে এটি প্রকৃতি থেকে পাওয়া ইউরেনিয়ামের চেয়ে অনেক কম তেজস্ক্রিয়।
এ নিয়ে কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক মারিনা মিরন বলেন, শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি গোলা যদি মাটিতে পড়ে, তবে তা থেকে মাটি দূষিত হতে পারে। এ কারণেই কসোভোয় যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির ন্যাটো মিত্ররা এই অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তখন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
২০০৭ সালে মানবশরীরের ওপর ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি অস্ত্রের প্রভাব নিয়ে একটি পর্যালোচনা চালানোর নির্দেশ দেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে অনেকগুলো পর্যালোচনা চালিয়েছে।
পরে ২০০৬ সালে আণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের বৈজ্ঞানিক কমিটি (ইউএনসিইএআর) জানায়, তারা ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম থেকে উল্লেখযোগ্য তেমন বিষক্রিয়া হতে দেখেনি। তবে আইএইএ সতর্ক করে জানিয়েছে, যাঁরা ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামে তৈরি গোলাগুলো নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।
২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এনভায়রনমেন্ট পলিউশন নামে একটি সাময়িকীতে ২০০৯ সালে বলা হয়েছিল, ইরাকের নাসিরিয়াহ শহরে শিশুদের জন্মগত ত্রুটির সঙ্গে এই অস্ত্র ব্যবহারের সংযোগ থাকতে পারে।
এদিকে ইউক্রেনে ডিপ্লিটেড ইউরিনিয়ামের অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি)। ২০২২ সালে তারা জানিয়েছিল, এই অস্ত্রের কারণে দেশটির মানুষের ত্বকে জ্বালাপোড়া ও কিডনির সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া বাড়তে পারে ক্যানসারের ঝুঁকি। ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে এর রাসায়নিক বিষক্রিয়া বেশি ক্ষতিকর।
ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের অস্ত্রগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই সেগুলো নিষিদ্ধ করা নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি হয়নি।
তবে ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন টু ব্যান ইউরেনিয়াম ওয়েপনস নামে একটি সংগঠন ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের অস্ত্রগুলোকে অবৈধ ঘোষণার দাবি করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এই অস্ত্রগুলো পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ কারণে ‘যুদ্ধ অনির্দিষ্ট মেয়াদে চলতে থাকে’।
এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা দপ্তর বলছে, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাতে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামের অস্ত্র ব্যবহার বৈধ।
চলতি বছরের শেষের দিকে ইউক্রেনে এম-১ আব্রামস ট্যাংক পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ট্যাংকে ব্যবহারের জন্য ১২০ মিলিমিটারের ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম গোলা দেওয়া হবে।
এদিকে এরই মধ্যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর হাতে চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক তুলে দিয়েছে যুক্তরাজ্য। ওই ট্যাংকে ব্যবহারের জন্য ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি গোলা পাঠানো হবে বলে গত মার্চে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা দপ্তর।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। এ নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, এই অস্ত্রগুলোতে ‘পারমাণবিক উপাদান’ রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করলে তিনি পাল্টাজবাব দিতে বাধ্য হবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।