কিছুদিন ধরে ইউক্রেনজুড়ে থেমে থেমেই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে। বিশেষত দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে শীত মৌসুমে চরম বিপাকে পড়েছে ইউক্রেনবাসী। এই পরিস্থিতিতে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে সুরক্ষা দিতে কিয়েভের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একের পর এক রুশ হামলায় জর্জরিত ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াশিংটন। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাওয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই। কেননা গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর পর কিয়েভকে সরবরাহ করা ওয়াশিংটন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা হবে এই প্যাট্রিয়ট।
বিশ্লেষকদের মতে, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউক্রেনকে দুটি সুবিধা দেবে। প্রথমত, দেশটির বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে রাশিয়া থেকে উৎক্ষেপিত স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে আছে ও থাকবে, এমন একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র চেয়ে আসছিলেন। কেননা রুশ হামলার কারণে লাখো ইউক্রেনীয় বর্তমানে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। তীব্র শীতের মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকায় তারা নিজেদের ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। শীত জেঁকে বসায় সংকট আরও জোরালো হয়েছে। ইউক্রেনীয়দের বাঁচাতে কিয়েভের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে অনুরোধ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান রেথিয়নের তৈরি প্যাট্রিয়ট মূলত ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য একটি ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা। এটি থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, যুদ্ধযান ধ্বংস করা সম্ভব। গত শতকের আশির দশকে প্রথম এই ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র।
একেকটি প্যাট্রিয়ট–ব্যবস্থায় একটি ট্রাক থাকে, সেটায় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি ট্রাকে আটটি লঞ্চারের পাশাপাশি ভূমিতে অবস্থিত রাডার, একটি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ও একটি জেনারেটর থাকে। মার্কিন সেনাবাহিনীতে এখন ১৬টি প্যাট্রিয়ট ব্যাটালিয়ন রয়েছে।
প্যাট্রিয়ট একটি ভরসা করার মতো ও বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহারযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে এই ব্যবস্থা ইউক্রেনকে আরও বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে।টম কারাকো, সিএসআইএস–এর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের পরিচালক।
২০১৮ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, একেকটি ব্যাটালিয়ন ৫০টি ব্যাটারি পরিচালনা করতে পারে, যার ফলে এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২০০–এর বেশি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্যাট্রিয়ট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে ওয়াশিংটন। ইউরোপের জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, গ্রিস, স্পেন, সুইডেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, এশিয়ার জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনে রয়েছে মার্কিন এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গত শতকের আশির দশকে প্রথম ব্যবহার করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি আধুনিক করা হয়েছে। তাই ব্যয়ও বেড়েছে। রেথিয়ন জানিয়েছে, ২০১৫ সালের পর থেকে তারা প্যাট্রিয়ট–ব্যবস্থার জন্য ১৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ব্যবস্থা ব্যবহার করে একেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে ৪০ লাখ ডলার ব্যয় হয়। এ ছাড়া একেকটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে ব্যয় হয় এক কোটি ডলার।
এ জন্য সিএসআইএস–এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, মাত্র ৫০ হাজার ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করা একটি ড্রোন ধ্বংস করতে লাখো ডলারের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ব্যবহার মোটেও লাভজনক কিছু নয়।
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। এর ব্যাটারি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ৯০ জনের বেশি মানুষ প্রয়োজন। তাই এই ব্যবস্থা দেওয়ার আগে ইউক্রেনের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে জো বাইডেন প্রশাসন। এ জন্য আগেভাগে ইউক্রেনে বিশেষ প্রশিক্ষক পাঠানো হয়েছে।
মার্কিন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যুদ্ধে ইউক্রেনকে এগিয়ে রাখবে বলে মনে করছেন সিএসআইএস–এর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পের পরিচালক টম কারাকো। তিনি বলেন, প্যাট্রিয়ট একটি ভরসা করার মতো ও বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহারযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউক্রেনকে আরও বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউক্রেনকে দুটি সুবিধা দেবে। প্রথমত, দেশটির বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে রাশিয়া থেকে উৎক্ষেপিত স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে আছে ও থাকবে, এমন একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।
তবে সীমাবদ্ধতার কথাও এসেছে বিশ্লেষকদের মতামতে। তাঁরা বলছেন, প্যাট্রিয়ট মূলত একটি ছোট আকারের সেনা ঘাঁটিকে সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি সক্ষম। তবে এটি ব্যবহার করে কিয়েভের মতো বড় একটি শহর রক্ষা করা সম্ভব নয়। রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বড় বড় শহর ও স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। প্যাট্রিয়ট এসব হামলা থেকে স্থাপনাকে সুরক্ষা দিতে পারলেও পুরো একটি শহরকে রক্ষা করতে পারবে না।
তাই মার্ক ক্যানসিয়ানের মতে, ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনে প্রকৃত লাভের চেয়ে প্রতীকী গুরুত্ব বেশি।
ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরবরাহের পদক্ষেপকে রাশিয়া একটি ‘উসকানি’ হিসেবে গণ্য করছে। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাঠালে সেগুলো রুশ হামলার বৈধ লক্ষ্যবস্তু হবে বলেও সতর্ক করেছেন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ।
পুতিনপন্থী হিসেবে পরিচিত মেদভেদেভ ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পরে ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। বর্তমানে দেশটির নিরাপত্তা পর্ষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন মেদভেদেভ। এই পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট পুতিন।
যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে পুতিনের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ মেদভেদেভের এ হুঁশিয়ারি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে বলছেন বিশ্লেষকেরা। কেননা রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, আসন্ন ‘ক্রিসমাস’ বা বড়দিনের উৎসবের সময়ও যুদ্ধবিরতির কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি শান্তি প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছে রাশিয়া।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেন সরকার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে রুশ বাহিনী নতুন করে কিয়েভে হামলা চালাতে পারে। এ লক্ষ্যে দুই লাখ সেনা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্রেমলিন। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে যুদ্ধপরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নিতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
আল–জাজিরা ও রয়টার্স অবলম্বনে