যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন দেশটিতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। তবে তখন কিয়ার স্টারমার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। এ ছাড়া বিরোধী দলে থাকার সময় স্টারমারের পক্ষে তহবিল সংগ্রহের জন্য আয়োজিত এক নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এমন সময় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো, যখন যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিভিন্ন বাড়িতে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) টিউলিপ সিদ্দিকের অবস্থান করা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এ পদে দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন তিনি।
টিউলিপ গত আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। গত ১৫ বছরে তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশে বিরোধীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার ও গোপনে কারাবন্দী করার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও চালানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা এখনো সক্রিয়। এই শাখার সদস্যরা অতীতে টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষেও প্রচার চালিয়েছে। জানা গেছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আহাদ চৌধুরীসহ নেতা–কর্মীরা স্টারমারের পক্ষে তাঁর হলবর্ন ও সেন্ট প্যানক্রাস নির্বাচনী এলাকায় প্রচার চালান। এ আসনটি টিউলিপ সিদ্দিকের নির্বাচনী এলাকা হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেটের পাশে অবস্থিত।
ছবিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিয়ার স্টারমারের ছবিসংবলিত প্রচারপত্র বিলি করার সময় আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের দেখা গেছে। স্টারমারের দলের সমর্থনে ছাপানো প্ল্যাকার্ড হাতেও দেখা গেছে তাঁদের। একই দিনে তাঁরা টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য প্রচার–প্রচারণায় এমন সব ব্যক্তিকে দেখা গেছে, যাঁরা সরাসরি আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
আবদুল আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেও কিয়ার স্টারমারের সাক্ষাৎ হয়েছে। এর মধ্যে একটি অনুষ্ঠান স্টারমারের জন্য তহবিল সংগ্রহের নৈশভোজ ছিল বলে জানিয়েছেন আবদুল আহাদ নিজেই। ২০১৬ সালে একটি রেস্তোরাঁয় ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গত জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের দিন স্টারমারের সঙ্গে করমর্দনরত একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন আবদুল আহাদ। ছবির শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী মাননীয় কিয়ার স্টারমার।’ তবে কবে ওই ছবি তোলা হয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়।
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের দিন আবদুল শহীদ শেখ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গেও দেখা যায় কিয়ার স্টারমারকে। সেদিন লেবার দলের প্রার্থী স্যাম টেরির হয়ে ইলফোর্ড এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়েছিলেন তিনি। আবদুল শহীদ আওয়ামী লীগের পক্ষে জনসংযোগমূলক কাজ করেন বলে জানিয়েছেন। একই দিনে তিনি অ্যাঞ্জেলা রেনারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অ্যাঞ্জেলা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের উপপ্রধানমন্ত্রী।
এদিকে আবদুল আহাদ চৌধুরী ছাড়াও ২০১৯ সালের ছবিতে হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্ন (বর্তমানের হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেট) এলাকায় টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা গেছে শাহ শামীম আহমেদ ও সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুককে। শাহ শামীম নিজেকে যুক্তরাজ্য শাখা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং সাজিদুর রহমান নিজেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগের এই সদস্যরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিউলিপের প্রতি খোলাখুলিভাবে সমর্থন জানালেও বর্তমানে তা জারি আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশেও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে টিউলিপের ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনের তথ্য চেয়েছে অর্থ পাচার রোধে কাজ করা সংস্থা। এ ছাড়া অবকাঠামো প্রকল্প থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগে টিউলিপ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিভিন্ন বাড়িতে টিউলিপের বসবাস নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর নীতিনৈতিকতাবিষয়ক উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে কিয়ার স্টারমারের বাংলাদেশ সফরসহ শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে সাত দিনের বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন স্টারমার। তাঁর ওই সফরের আয়োজন করেছিল টিউলিপ সিদ্দিক–ঘনিষ্ঠ ‘লেবার ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। সে সময় তোলা একটি ছবিতে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে স্টারমারকে দেখা যায়। ২০২২ সালেও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া বিরোধী দলে থাকার সময় যুক্তরাজ্যের অন্তত তিনজন মন্ত্রী তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।