রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

তুরস্কের নির্বাচনে এরদোয়ানকে যেসব হিসাব চোকাতে হবে

১৪ মে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জন্য এটি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। কয়েকটি জনমত জরিপে দেখা গেছে, বিরোধীদলীয় প্রার্থী কেমাল কিলিচদারোগলুর চেয়ে এরদোয়ান পিছিয়ে আছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরদোয়ান যদি এবার ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন, তবে তা হবে তাঁর অর্থনৈতিক নীতিমালাজনিত কয়েকটি ভুল পদক্ষেপের কারণে।

এরদোয়ান ও তাঁর একে পার্টির প্রথম এক দশকের শাসন মেয়াদে তুরস্কে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন হতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী দশক থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। মুদ্রার মান কমে যাওয়া এবং জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে এরদোয়ানের প্রতি মানুষের সমর্থন কমতে দেখা গেছে। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা কমার এ প্রবণতা শুরু হয়েছে মূলত ২০১৩ সাল থেকে।

ওই বছর তুরস্কজুড়ে এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে, বিরোধীদের ওপর ধরপাকড় চালানো হয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক সংকটের কারণে তুরস্ক এবং অন্য উদীয়মান বাজারগুলো তহবিল-সংকটে পড়ে।

২০১৩ সালের শুরু থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুরস্কে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে থাকেন। এতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, আমানত ও ঋণের বাজার ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।

ইস্তাম্বুলের ইসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন সেদা দিমিরাইপ বলেন, অতীতে এরদোয়ান তাঁর সমর্থকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারতেন। এখন অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা এখনো তাঁকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু এ জন্য তাঁদের যে মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তা নিয়ে তাঁরা অখুশি।

একেপির শাসনামলের প্রথম দিকের সময়গুলোতে উৎপাদনে অগ্রগতি দেখা গেছে। তবে ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। ঋণ হয়ে ওঠে প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। পাশাপাশি তুরস্কের মুদ্রার দাম কমে যায়। ২০১৩ সাল থেকে তুরস্কের পরিবর্তিত পরিস্থিতি কিংবা ডলারের হিসাবে তুর্কিদের ধনসম্পদ কমতে থাকার জন্য এটিকে একটি সম্ভাব্য কারণ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
কেওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মুরাত উচার

তবে জনমত জরিপ বলছে, রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণির কাছে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন এরদোয়ান। তিনি ও তাঁর ক্ষমতাসীন জোটের এখনো প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে জেতার সুযোগ আছে।

এরদোয়ান সরকার বলছে, সুদের হার কমানোর কারণে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বেড়েছে। গত ১৮ মাসে ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ বেড়েছে। সামাজিক সহায়তা বাবদ রেকর্ড পরিমাণে খরচ হয়েছে। আর এতে গত বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৫-এর বেশিতে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। গত দুই বছরে বেকারত্বের হার প্রায় ১৪ থেকে কমে ১০-এ দাঁড়িয়েছে।

তবে ২০২১ সাল থেকে সুদ ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করায় যে মূল্যস্ফীতি, তা এরদোয়ানের ক্ষমতাকালে সর্বোচ্চ। গত বছর মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৮৫ শতাংশের বেশি।

আয় ও সম্পদের বণ্টনসংক্রান্ত গিনি সূচক অনুযায়ী ২০১১ সালে তুরস্কে বৈষম্যের হার বাড়তে শুরু করে। ২০১৩ সালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শাসন মেয়াদে এরদোয়ানের যে বড় অর্জনগুলো ছিল, সেগুলো ঢাকা পড়ে যায়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক লেগানটাম ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সমৃদ্ধিশালী দেশের সূচকে তুরস্কের অবস্থান বিশ্বে ৯৫তম। শাসনব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অবনতির কারণে ২০১১ সাল থেকে দেশটির ২৩ ধাপ অবনতি হয়েছে।

১৯৭০-এর দশকে তুর্কি অর্থনীতি সবচেয়ে মন্দার মধ্যে ছিল। ২০০২ সালে এরদোয়ানের একে পার্টি যখন নির্বাচিত হয়, তখন দেশটি অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠছিল। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও মন্দা দূর করার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে এরদোয়ানের দল ক্ষমতায় আসে।

২০১৩ সালের শুরু থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুরস্কে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে থাকেন। এতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, আমানত ও ঋণের বাজার ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে।

এরপর মূল্যস্ফীতি কমে আসে, তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান বাড়তে থাকে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তখন এরদোয়ানের আশপাশে কেউ পৌঁছাতে পারেননি।

তবে ২০১৩ সালে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। তখন এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ইস্তাম্বুলের গেজি পার্কে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন জায়গায় সরকারবিরোধীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হতে থাকে। বিরোধীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

ইস্তাম্বুলের কেওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মুরাত উচার বলেন, একেপির শাসনামলের প্রথম দিকের সময়গুলোতে উৎপাদনে অগ্রগতি দেখা গেছে। তবে ২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। ঋণ হয়ে ওঠে প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। পাশাপাশি তুরস্কের মুদ্রার দাম কমে যায়। ২০১৩ সাল থেকে তুরস্কের পরিবর্তিত পরিস্থিতি কিংবা ডলারের হিসাবে তুর্কিদের ধনসম্পদ কমতে থাকার জন্য এটিকে একটি সম্ভাব্য কারণ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

সাবানচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আতেস আলতিনোরদু মনে করেন, ২০১৬ সালে এরদোয়ানকে উৎখাতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরপরই রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর জরুরি অবস্থা জারি হয়। আর তখনই তোয়াজকারী উপদেষ্টাদের নিয়ে এরদোয়ানের একচ্ছত্র শাসন শুরু হয়। আর এতে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার মাত্রা আরও জোরালো হয়েছে।

২০০৩ সালে এরদোয়ান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্কের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। এর বদৌলতে পরবর্তী সময়ে একেপি ১২টির বেশি নির্বাচনে জয় পেয়েছিল।

২০২১ সালে প্রকাশিত ‘অ্যা সুলতান ইন অটাম’ নামের বইতে সোনের কাগাপতে লিখেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর বেশির ভাগ সময়ে তুরস্কের নাগরিকদের জীবনযাপনের মান যেমন ছিল, তার তুলনায় এরদোয়ানের শাসনামলে জীবনযাপনের মান উল্লেখজনকভাবে বেশি ভালো ছিল। আর তাতে তাঁর ভক্ত ও অনুগত সমর্থকের সংখ্যা বেড়েছে।’

এরদোয়ান সরকার বলছে, সুদের হার কমানোর কারণে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বেড়েছে। গত ১৮ মাসে ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ বেড়েছে। সামাজিক সহায়তা বাবদ রেকর্ড পরিমাণে খরচ হয়েছে। আর এতে গত বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশিতে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। গত দুই বছরে বেকারত্ব প্রায় ১৪ থেকে কমে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার আগে তুরস্কে নবজাতকদের মৃত্যুহার যুদ্ধপূর্ববর্তী সিরিয়ার মতো ছিল। আর এখন তা স্পেনের মতো।

তবে গত দশকে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিতের জন্য এরদোয়ান জাতীয়তাবাদী মিত্রদের সঙ্গে জোট গড়ার পর থেকে তুরস্কজুড়ে রাজনৈতিক বিভাজন জোরদার হয়েছে। পরে ক্ষমতা আরও সুসংহত করার জন্য আয়োজিত গণভোটে জয়ী হন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

এরদোয়ানের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার এ প্রবণতার বিরোধিতা করে একে পার্টির কয়েকজন অর্থনৈতিক কর্মকর্তা দল ত্যাগ করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ওই সময় থেকেই দলটির নীতিমালার দুর্বলতাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।

তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বুলেন্ত গুলতেকিন বলেন, এরদোয়ানের শাসনামলের শুরুর দিকের সময়গুলোর কথা সবাই স্মরণ করে। তাঁকে তখন অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে দেখা গেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এর মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষদের একাংশ সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল এবং তা টেকসই হয়নি।

গুলতেকিন মনে করেন, এরদোয়ান যদি নির্বাচনে জয়ী হন এবং তাঁর অর্থনৈতিক নীতিমালাগুলো বহাল রাখেন, তাহলে এক অর্থে পুরোপুরি ধস নেমে আসবে।