রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাসের মাথায় এসে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের বড় এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন রুশ সেনারা। এখন সেসব এলাকার একটি অংশ থেকে তাঁদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে ইউক্রেন বাহিনী। আধুনিক পশ্চিমা সমরাস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনের সেনাদের এ সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন দেশটির নীতিনির্ধারকেরা। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকোভ বলেছেন, এটা সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে রাশিয়াকে পরাজিত করা যাবে। খবর বিবিসি ও আল–জাজিরার।
ইউক্রেনের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ অঞ্চল থেকে দখলদার রুশ বাহিনীকে হটাতে গত সপ্তাহে বড় মাত্রায় আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেন। এরই মধ্যে তারা ওই অঞ্চলের তিন হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী আজ সোমবার বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তারা খারকিভ অঞ্চলের ২০টি গ্রাম দখলদারমুক্ত করেছে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন অঞ্চলের ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেছে।
রাশিয়াও খারকিভ থেকে সেনাদের সরে আসার কথা স্বীকার করেছে। গতকাল রোববার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রকাশিত একটি মানচিত্রে প্রায় পুরো খারকিভ অঞ্চল থেকে সেনাদের সরে আসার চিত্র দেখা গেছে। ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দুই শহর ইজিয়াম ও কুপিয়ানস্ক পুনর্দখল ইউক্রেন বাহিনীর জন্য কৌশলগতভাবে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ দুই শহরে খারকিভ অঞ্চলের প্রশাসনিক দপ্তর গড়ে তুলেছিল রাশিয়া। সেনাদের রসদ যেত শহর দুটি থেকে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলেছে, ইউক্রেনের সেনারা ইজিয়াম শহর ঘিরে ফেলার পর রুশ সেনারা যেভাবে পেরেছেন, ওই এলাকা থেকে পালিয়েছেন। তাঁরা বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
খারকিভ অঞ্চলে নিয়োজিত রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তা ভিতালি গনচেভ জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে ইউক্রেন বাহিনী যে হামলা শুরু করে, সেখানে রুশ সেনাদের তুলনায় তাদের বহর ছিল অনেক বড়। একজন রুশ সেনার বিপরীতে ইউক্রেনের সেনার সংখ্যা দাঁড়ায় আটজনে। তাঁরা খারকিভের উত্তরাঞ্চলের বসতিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। ইউক্রেনের সেনারা রাশিয়ার বেলগোরোদ সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসছেন। আজ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত রোসিয়া–২৪ টেলিভিশন চ্যানেলকে ভিতালি গনচেভ বলেন, ‘প্রতি ঘণ্টাতেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।’ ওই এলাকা থেকে পাঁচ হাজার বেসামরিক লোককে উদ্ধার করে রাশিয়ায় আনা হয়েছে।
রুশ সেনাদের এভাবে বেকায়দায় পড়ার পেছনে দেশটির সেনার সংখ্যায় ঘাটতির কথা বলেছে ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে গতকাল বলা হয়, এ যুদ্ধ সম্ভবত সামনের বছরে গড়াবে। তবে ইউক্রেন বাহিনী যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ তাদের অনুকূলে এখনো ধরে রাখতে পেরেছে। পশ্চিমাদের দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা হাইমোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমের (হিমার্স) মতো আধুনিক সমরাস্ত্রের সদ্ব্যবহার এবং কার্যকর যুদ্ধকৌশলের কারণে তারা এটা সম্ভব করতে পেরেছে।
তবে যুদ্ধে সাময়িক পিছু হটলেও ইউক্রেনে লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকার কথা জানিয়েছে মস্কো। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য অর্জন হবে, ততক্ষণ তা চলতে থাকবে।’
অবশ্য রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ইউক্রেন নিয়ে সমঝোতার বিপক্ষে নয় রাশিয়া। তবে এ জন্য তারা যত বেশি সময় নেবে, তাতে কোনো বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো তত বেশি কঠিন হবে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তিন দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা চালায় রুশ বাহিনী। একপর্যায়ে ইউক্রেনের উত্তর–পশ্চিমে রাজধানী কিয়েভের কাছ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে রাশিয়া। পরে কিয়েভসহ দেশটির বড় এলাকা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন নিজেদের সীমান্তবর্তী ইউক্রেনের উত্তর–পূর্বাঞ্চল দখলে মনোযোগ দেয় রুশ বাহিনী। ওই অঞ্চলে ইউক্রেন বাহিনীর বিরুদ্ধে রুশ সেনাদের সঙ্গে মিলে রুশপন্থী বিদ্রোহীরা লড়াই চালিয়ে আসছে। এরই মধ্যে এ অঞ্চলের খারকিভের দখল হারাল রুশ বাহিনী। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের খেরসনসহ কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী কিছু এলাকা এখনো রাশিয়ার দখলে রয়েছে। গতকাল ছিল যুদ্ধের ২০১তম দিন। এ যুদ্ধে ১৪ হাজারের বেশি বেসামিরক ব্যক্তি হতাহত হয়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।