ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতি

শস্য রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বাড়ল

রাশিয়ার সঙ্গে শস্যরপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বেড়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো দিয়ে শস্য রপ্তানি চুক্তি ঘিরে যে আশঙ্কা ছিল, তা কেটে গেছে। ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তির মেয়াদ আরও চার মাস বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ ঘোষণা আসে। শনিবার এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর আগেই চুক্তিটি নবায়ন করতে সম্মত হয়েছে রাশিয়া।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। শস্য ও তেলবীজ উৎপাদনকারী অন্যতম দেশ ইউক্রেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে শস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। গত জুলাই মাসে তুরস্ক ও জাতিসংঘের প্রচেষ্টায় রাশিয়া ওই ইউক্রেনের মধ্যে বন্দরগুলো দিয়ে শস্য রপ্তানি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এর আওতায় বিশ্বজুড়ে খাদ্যঘাটতি পূরণে সমুদ্রপথে একটি নিরাপদ করিডর তৈরির কথা বলা হয়। এতে ইউক্রেনের তিনটি বন্দর থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানির পথ খুলে যায়।

চুক্তির পর থেকে এই নৌপথ ব্যবহার করে ১ কোটি ১১ লাখ টন কৃষিপণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ লাখ টন খাদ্যশস্য রয়েছে। মোট রপ্তানির মধ্যে ২৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩২ লাখ টন গম রপ্তানি হয়েছে। এর বাইরে সূর্যমুখী তেল, খাদ্যদ্রব্য, বার্লি প্রভৃতি রপ্তানি হয়েছে।

চুক্তি নবায়নের আগে জাতিসংঘ ও ইউক্রেনের চাওয়া ছিল ভিন্ন। তারা চাইছিল চুক্তির মেয়াদ কমপক্ষে এক বছর করা হোক। কিন্তু রাশিয়া তাতে সম্মত হয়নি। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে অন্য বন্দরগুলো ব্যবহার করতে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতেও মস্কোর সাড়া মেলেনি। বর্তমানে ওদেসা, ক্রোনমোরস্ক ও পিভদেয়ানি বন্দর দিয়ে মাসে ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। তবে ইউক্রেনের চাওয়া ছিল মাইকোলাইভ অঞ্চলের বন্দরগুলো দিয়ে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হোক। রুশ বাহিনীর আক্রমণের আগে মাইকোলাইভ অঞ্চলের বন্দরগুলো দিয়ে ইউক্রেনের মোট ৩৫ শতাংশ রপ্তানি হতো। এখানে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শস্য টার্মিনালও রয়েছে।

এর আগে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে তাদের শর্তের কথা বলা হয়। রাশিয়ার শর্তের মধ্যে ছিল, তাদের নিজস্ব শস্য ও সার রপ্তানি বিধিনিষেধ না রাখা। বিশ্বের অন্যতম কৃষিপণ্য উৎপাদক ও গম রপ্তানির শীর্ষ দেশ রাশিয়া।

রাশিয়ার অন্য দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রীয় কৃষিঋণদাতা রোসেলখোজ ব্যাংকের ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। এতে তাদের শস্য রপ্তানিতে সুবিধা হবে। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান চুক্তির কোনো পরিবর্তন না এনেই ১২০ দিনের জন্য এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সামনে নিজস্ব শস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সহজ শর্তের বিষয়গুলো বিবেচনা করবে মস্কো।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে এই চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার গম তুরস্কে এনে তা থেকে আটা তৈরি করে আফ্রিকার দেশগুলোতে পাঠানো হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সব পক্ষই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় করা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। তবে এর আগে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল।

গুতেরেস টুইটারে বলেছেন, ‘ইউক্রেন থেকে শস্য, খাদ্যসামগ্রী এবং সার রপ্তানি সহজ করতে কৃষ্ণসাগর বন্দর দিয়ে শস্য রপ্তানি চুক্তি চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব পক্ষের সম্মতির বিষয়টিকে আমি স্বাগত জানাই। উদ্যোগটি বহুপক্ষীয় সমাধান খোঁজার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ কূটনীতির গুরুত্ব প্রদর্শন করে।’

এক টুইটে ইউক্রেনের অবকাঠামোমন্ত্রী ওলেকজান্দার কুবরাকভ বলেন, চুক্তির মেয়াদ ১২০ দিন বাড়ানো হবে। এর আগে গত মঙ্গলবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, চুক্তির বর্তমান শর্তগুলো আগে পূরণ করতে হবে। এর আগে এ মাসের শুরুর দিকে রুশ নৌবহরে হামলার ঘটনায় চুক্তি থেকে সাময়িকভাবে বের হয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। পরে আবার চুক্তিতে ফিরে আসে।

ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল বলেন, চুক্তির বিষয়টি বিশ্বের জন্য ভালো সংবাদ। খাদ্যশস্য ও সার পাওয়ার জন্য এ চুক্তি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে তিনি জাতিসংঘ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনা থেকেই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।

ইউক্রেনজুড়ে ব্যাপক হামলা

শস্য চুক্তিকে সম্মত হলেও ইউক্রেনজুড়ে গতকাল আবারও ব্যাপক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ বাহিনী। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ সম্মেলনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর পর থেকে হামলা আরও জোরদার হয়েছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে গতকাল ব্যাপক হামলা চালানো হয়। হামলার শিকার হয়েছে ইউক্রেনের নিপ্রো শহরে একটি গ্যাস উৎপাদন কারখানা এবং একটি ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাও। এসব হামলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। গত মঙ্গলবারও দেশটির রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালানো হয়। ইউক্রেনে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে আবাসিক ভবনে হামলায় চারজন নিহত হয়েছেন। অপরদিকে নিপ্রো শহরে হামলায় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয় এমন একটি কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরের অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

কাছেই নিকোপোল শহরে প্রায় ৭০টি গোলা আছড়ে পড়েছে। গোলার আঘাতে শহরটির হাজার হাজার বাড়ি বিদ্যুৎ ও পানিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হামলার শিকার হয়েছে ওদেসা ও খারকিভ অঞ্চলও। এই দুই অঞ্চলে তিনজন করে আহত হয়েছেন।

পোল্যান্ড নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

মঙ্গলবার ইউক্রেন সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডের একটি গ্রামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দুজন নিহত হন। এ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎস নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছেই। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তাঁরা করেননি। রাশিয়াও অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট বলছে, এই হামলার উৎস ইউক্রেন। এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত দলে ইউক্রেনের প্রতিনিধিও রাখা হচ্ছে।