গর্বাচেভ আমল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনাপ্রবাহ

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ
ছবি: রয়টার্স

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার মস্কোর একটি হাসপাতালে ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রায় সাত বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর হাত দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে।
গর্বাচেভের দায়িত্ব পালনের সময়টি ছিল ঘটনাবহুল। তাঁর সময়কার ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ দিয়েছে রয়টার্স। পাঠকদের সামনে তা তুলে দেওয়া হলো:

মার্চ ১৯৮৫
মিখাইল সের্গেয়েভিচ গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন ৫৪ বছর বয়সে, তখন তিনি ছিলেন পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে বের করে আনতে তিনি পেরেস্ত্রোইকা (অর্থনৈতিক সংস্কার) এবং গ্লাসনস্ত (বাক্‌স্বাধীনতা) কর্মসূচি চালু করেন।

নভেম্বর ১৯৮৫
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন গর্বাচেভ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। গর্বাচেভ বলেন, উত্তেজনা প্রশমন (দাঁতাত) এবং অস্ত্রের ভবিষ্যৎ মজুত কমানোর বিষয়ে তিনি ‘খুবই আশাবাদী’।

এপ্রিল ১৯৮৬
চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লিতে বিস্ফোরণে ইউরোপজুড়ে ‘তেজস্ক্রিয় মেঘ’ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তিন দিন পরে গিয়ে সেটা স্বীকার করে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। ফলে গ্লাসনস্ত কর্মসূচি নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

ডিসেম্বর ১৯৮৬
গর্বাচেভের ফোনের পর ভিন্নমতাবলম্বী আন্দোলনের জনক আন্দ্রে শাখারভকে নির্বাসিত জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর শাসনামলে মুক্তি পাওয়া কয়েক শ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের একজন ছিলেন শাখারভ।

মে ১৯৮৭
ম্যাথিয়াস রাস্ট নামের এক জার্মান তরুণ হেলসিঙ্কি থেকে হালকা উড়োজাহাজ ‘চেসনা’ চালিয়ে সোভিয়েত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে মধ্য মস্কোর রেড স্কয়ারে অবতরণ করেন। এ ঘটনায় শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেন গর্বাচেভ।

অক্টোবর ১৯৮৭
অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি পেরেস্ত্রোইকা বাস্তবায়নের গতি নিয়ে গর্বাচেভের সঙ্গে বিরোধে জড়ান খ্যাতনামা রুশ সংস্কারক বরিস ইয়েলেৎসিন। তিনি ক্ষমতাসীন পলিটব্যুরো থেকে পদত্যাগ করেন।

ডিসেম্বর ১৯৮৭
পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত কমিয়ে আনতে ওয়াশিংটনে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করেন গর্বাচেভ ও রিগ্যান। চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সব আন্তমহাদেশীয় পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করা হবে।

অক্টোবর ১৯৮৮
জাতীয় আইনসভা সুপ্রিম সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান হয়ে গর্বাচেভ ক্ষমতা সুসংহত করেন।

ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর ৯ বছরের অভিযানের সমাপ্তি হয়। জর্জিয়া, ইউক্রেনসহ বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোর স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।

মার্চ ১৯৮৯
কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটির সদস্য নির্বাচনে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথমবারের মতো একাধিক প্রার্থীর অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়াসহ বাল্টিক দেশগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জয় পান।

নভেম্বর ১৯৮৯
জনপ্রিয় বিপ্লবে পূর্ব জার্মানি এবং পূর্ব ইউরোপের বাকি অংশে কমিউনিস্ট সরকারগুলোর পতন ঘটে। তবে নিজের প্রভাবাধীন এসব সরকারের পতন ঠেকাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালায়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন।

ডিসেম্বর ১৯৮৯
মাল্টায় বৈঠকে মিলিত হন গর্বাচেভ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের প্রশংসা করেন এই দুই নেতা।

ফেব্রুয়ারি ১৯৯০
কমিউনিস্ট পার্টি তার একচেটিয়া ক্ষমতা সমর্পণ করে। ব্যাপক ক্ষমতা বাড়িয়ে গর্বাচেভকে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিতে সম্মত হয় পার্লামেন্ট। সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে ব্যাপক সভা-সমাবেশ শুরু করে সংস্কারপন্থী বিক্ষোভকারীরা।

অক্টোবর ১৯৯০
‘ছয় শক্তির’ নিবিড় আলোচনার পর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি আবার একত্রীকরণ হয়। এ আলোচনায় গর্বাচেভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাজার অর্থনীতি গ্রহণে কমিউনিস্ট পার্টির মূল অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পরিত্যাগের প্রস্তাব অনুমোদন করে সোভিয়েত পার্লামেন্ট। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান গর্বাচেভ।

নভেম্বর ১৯৯০
সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রায় সব ক্ষেত্রে গর্বাচেভকে ডিক্রি জারি করার ক্ষমতা দেয় পার্লামেন্ট। গর্বাচেভের প্রস্তাবিত ইউনিয়ন চুক্তির প্রথম খসড়ায় ১৫টি প্রজাতন্ত্রকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া ও জর্জিয়া এতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে।

জানুয়ারি ১৯৯১
বাল্টিক অঞ্চলে স্বাধীনতাপন্থী বিক্ষোভে ব্যাপক দমন–পীড়ন চালায় সেনারা। লিথুয়ানিয়ায় ১৪ জন এবং লাটভিয়ায় পাঁচজন নিহত হন।

মার্চ ১৯৯১
সোভিয়েত ইউনিয়নকে নতুন ‘সম সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের ফেডারেশন’ হিসেবে রেখে দেওয়ার প্রস্তাবে গণভোটে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তবে ছয়টি প্রজাতন্ত্র এ ক্ষেত্রে ভোট বর্জন করে।

এপ্রিল ১৯৯১
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্ট তথা ওয়ারশ চুক্তি ভেঙে দেওয়া হয়।

জুন ১৯৯১
বরিস ইয়েলেৎসিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

আগস্ট ১৯, ১৯৯১
গর্বাচেভের কথিত অসুস্থতার কথা বলে তাঁর ডেপুটি গেনাদি ইয়ানায়েভ কট্টর কমিউনিস্ট জান্তার প্রধান হয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিছু এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এস্তোনিয়ার পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আগস্ট ২১, ১৯৯১
অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কেন্দ্রে রক্ষণশীল ককাস বিলুপ্ত হয়। এতে প্রজাতন্ত্রগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যাপক উদ্যমী হয়ে ওঠে। লাটভিয়ার পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আগস্ট ২৪, ১৯৯১
গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির সব সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দেন। সব রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ এবং দলটি যাতে নিজ থেকেই বিলুপ্ত করে তার পরামর্শ দেন। ইউক্রেনের পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাজাখস্তান ও রাশিয়া ছাড়া বাকিরাও একই পথ অনুসরণ করে।

সেপ্টেম্বর ৬, ১৯৯১
লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত সর্বোচ্চ আইনসভা। কংগ্রেস ১৯২২ সালের ইউনিয়ন চুক্তি বাতিল করে। স্বেচ্ছায় ‘সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ইউনিয়ন’ গঠনে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

নভেম্বর ১৬, ১৯৯১
সোভিয়েত মালিকানাধীন প্রায় সব স্বর্ণ ও হীরার মজুত এবং তেল রপ্তানির নিয়ন্ত্রণ নেয় রাশিয়া। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

ডিসেম্বর ৮, ১৯৯১
রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ কিংবা গর্বাচেভের ভূমিকা থাকবে না। প্রথমে নতুন এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন গর্বাচেভ এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ধীরে ধীরে এই অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে নেন।

ডিসেম্বর ২৫, ১৯৯১
গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও বিলুপ্তি ঘটে।