২০১৩ সালের গ্রীষ্মকাল। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। সাইকেলে চেপে ছুটে এলেন এক ব্যক্তি। মাথা পোশাকে ঢাকা। সাইকেল থেকে লাফিয়ে নেমেই গুলি চালালেন পরপর দুবার। শিকার মস্কোর একটি রেস্তোরাঁর মালিক। হত্যার পরপরই সেখান থেকে পালালেন আততায়ী।
পরের ঘটনা এর ছয় বছর পরের। সেবার জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। রাশিয়া থেকে নির্বাসিত চেচেন কমান্ডার জেলিম খান খানগোশভিলিকে একইভাবে হত্যা করা হয়। ওই ঘাতকও দিনদুপুরে সাইকেলে চেপে এসেছিলেন। তারপর গুলি চালিয়ে নিজের কাজ সারেন তিনি।
২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চেচেন বিদ্রোহীদের একজন নেতা ছিলেন জেলিম খান খানগোশভিলি। তাঁকে হত্যার অভিযোগেই ক্রাসিকভ এখন জার্মানিতে বন্দী।
চেচেন কমান্ডারকে হত্যার পর জার্মানির পার্লামেন্ট ভবনের কাছে একটি নদীতে পিস্তল ও পরচুলা ফেলে দিয়েছিলেন ওই হামলাকারী। এরপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর কাছে পাওয়া পাসপোর্টে নাম লেখা ছিল ভাদিম সোকোলভ। তবে সেটি যে তাঁর আসল নাম নয়, তা শিগগিরই বুঝতে পারে জার্মান কর্তৃপক্ষ।
ওই হত্যাকারী আসলে রাশিয়ার নাগরিক, নাম ভাদিম ক্রাসিকভ। শক্তপোক্ত শারীরিক গড়নের, মাথায় টাক পড়া এই ব্যক্তির রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ২০১৩ সালে মস্কোয় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্তও তিনি।
ভাদিম ক্রাসিকভ এখন জার্মানিতে বন্দী। তাঁকে আবার রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাশিয়ায় বন্দী যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ইভান গার্শকোভিচকে মুক্তির বিনিময়ে ‘দেশপ্রেমিক’ ক্রাসিকভকে দেশে আনতে চায় মস্কো।
ইভান গার্শকোভিচ মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাঁকে রাশিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি মাসে তাঁর বন্দিজীবনের এক বছর পূরণ হচ্ছে। শুধু গার্শকোভিচই নন, যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক নাগরিকই বর্তমানে রাশিয়ার কারাগারে বন্দী।
পুতিন যদি আসলেই ক্রাসিকভকে রাশিয়ায় ফেরাতে চান, তাহলে জটিল এক বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে। এখানে একটি প্রশ্ন সামনে আসে, রাশিয়ার এই গোয়েন্দার মুক্তির জন্য পুতিন কেন এত উতলা?
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন বেলিংক্যাটের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে মস্কোয় রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হত্যায় ভাদিম ক্রাসিকভের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে দুই বছর পরই ওই পরোয়ানা তুলে নেওয়া হয়। ক্রাসিকভের নামও বলতে গেলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
ঠিক একই সময়ে সামনে আসেন ৪৫ বছর বয়সী ভাদিম সোকোলভ। ২০১৫ সালে রাশিয়ার পাসপোর্ট ও ২০১৯ সালে কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) পান তিনি। জার্মানির আদালতের রায় অনুযায়ী, এই নথিপত্রগুলো একমাত্র ক্রেমলিনের অনুমতিতেই পাওয়া সম্ভব। তাই বলা চলে, বার্লিনের হত্যাকাণ্ডে রাশিয়ার সমর্থন পেয়েছিলেন ক্রাসিকভ।
ক্রাসিকভ ছিলেন এফএসবির অতিগোপনীয় ‘ভিমপেল’ ইউনিটের সদস্য।
২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চেচেন বিদ্রোহীদের একজন নেতা ছিলেন জেলিম খান খানগোশভিলি। সে সময়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল চেচনিয়া। তাঁকে হত্যার অভিযোগেই ক্রাসিকভ এখন জার্মানিতে বন্দী। তবে এই হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ক্রেমলিন। ক্রাসিকভের বিরুদ্ধে জার্মান আদালতের রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেছে তারা।
তবে সাম্প্রতিক ওই সাক্ষাৎকারে পুতিন একপ্রকার স্বীকারই করে নিয়েছেন যে খানগোশভিলি হত্যায় রাশিয়ার হাত আছে। তিনি বলেছেন, ইউরোপের একটি দেশের রাজধানীতে একজন ‘দস্যুকে নির্মূলকারী’ রুশ ‘দেশপ্রেমিককে’ ফিরিয়ে আনতে আলোচনা চলছে।
বার্লিনে ভাদিম ক্রাসিকভের বিচারে সংশ্লিষ্ট কৌঁসুলিদের ভাষ্যমতে, তিনি ছিলেন এফএসবির অতিগোপনীয় ‘ভিমপেল’ ইউনিটের সদস্য। এ বিষয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ মার্ক গালেওত্তি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ভিমপেলের কাজ হলো দেশে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানো। তবে অনেক ক্ষেত্রে তারা দেশের বাইরে গুপ্তহত্যা চালিয়ে থাকে।
এফএসবির সঙ্গে ক্রাসিকভের সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কেন পুতিন সাবেক এই গোয়েন্দাকে ইভান গার্শকোভিচের মতো উচ্চপর্যায়ের বন্দীর সঙ্গে বিনিময় করতে চান। তবে বিশেষজ্ঞ মার্ক গালেওত্তির মতে, সম্ভাব্য এই বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে পুতিন মূলত দেশের বাইরে থাকা রুশ গোয়েন্দাদের একটি বার্তা পাঠাতে চান।
গালেওত্তি বলেন, ‘তাদের (রাশিয়া) ভাষ্য এমন—“দেখুন, আপনারা (বিদেশে থাকা গোয়েন্দা) যদি ধরা পড়েন, তাহলে যেকোনোভাবে আমরা আপনাকে দেশে ফিরিয়ে আনব। হয়তো লম্বা সময় লাগতে পারে, তবে ফিরিয়ে আনবই।” মানুষ (গোয়েন্দা) যেন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জড়ায়, সে জন্য এমন বার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’