ইউক্রেনে রুশ হামলার পাঁচ মাস পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া অনেক রুশ অস্ত্র অক্ষত কিংবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় জব্দ করেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হওয়া ৪৫০টির বেশি উপকরণ বা যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এনেছে মস্কো। এমনকি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগেই কয়েক বছরে অস্ত্র তৈরির নানা যন্ত্রাংশ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আমদানি করেছে ক্রেমলিন। খবর আল–জাজিরার।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জব্দ হওয়া রুশ অস্ত্রের অন্তত ২৭টিতে পশ্চিমা যন্ত্রাংশের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)। এসব অস্ত্রের মধ্যে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে।
আরইউএসআই আরও জানিয়েছে, রুশ অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হওয়া যন্ত্রাংশগুলোর দুই–তৃতীয়াংশই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর। এ ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের কোম্পানির তৈরি যন্ত্রাংশও ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে যাওয়া রুশ অস্ত্রে পাওয়া গেছে।
আরইউএসআই বলছে, নিজেদের সমরাস্ত্র তৈরিতে অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আনা মাইক্রোচিপ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে রাশিয়া। তবে বিষয়টি বুঝতে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ বিলম্ব হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ক্রিমিয়ায় হস্তক্ষেপ করলেন, তারপর থেকে বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে পশ্চিমারা।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এতে ব্যবহার হওয়া রুশ অস্ত্র তৈরির উৎস সম্পর্কে আরইউএসআই–এর এ গবেষণাকে সবচেয়ে জোরালো ও গভীর অনুসন্ধান বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষক ও অস্ত্র বিশেষজ্ঞ জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরিতে রাশিয়া পশ্চিমা যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এসব অস্ত্র ইউক্রেনে হাজারো সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ায় অস্ত্র তৈরির যন্ত্রাংশ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রপ্তানিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি দাবি জানিয়েছে আরইউএসআই। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মতো প্রাত্যহিক ব্যবহারের অনেক গৃহস্থালী পণ্য তৈরিতে পশ্চিমা দেশ ও কোম্পানিগুলোর যন্ত্রাংশ–প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, প্রাণঘাতী অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে। এটা বন্ধ করা প্রয়োজন।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরিতে রাশিয়া পশ্চিমা যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এসব অস্ত্র ইউক্রেনে হাজারো সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।জ্যাক ওয়াটলিং, গবেষক ও অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, আরইউএসআই
রাশিয়ার ৯এম৭২৭ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উদাহরণ টেনে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এটা রুশ সেনাবাহিনীর হাতে থাকা অত্যাধুনিক একটি অস্ত্র। এটি অনেক নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। ফাঁকি দিতে পারে রাডার। এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করা ৩১টি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেছে রাশিয়া, যার বেশিরভাগই তৈরি করেছে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি।
একইভাবে রাশিয়ার খ–১০১ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রেও ৩১টি পশ্চিমা যন্ত্রাংশের উপস্থিতি পেয়েছে আরইউএসআই। এসব যন্ত্রাংশ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেল করপোরেশন ও জিলিনক্স। এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
ইনটেল করপোরেশন ও জিলিনক্স জানিয়েছে, তারা অনেক আগে রাশিয়ার কাছে মাইক্রোচিপ ও যন্ত্রাংশ রপ্তানি করেছিল। তবে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে তারা। মেনে চলা হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শর্ত।
একই কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেমিকন্ডাকটর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যানালগ ডিভাইসেস, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস, ইনফিনিয়ন। প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য, তাদের তৈরি যন্ত্রাংশ দিয়ে বানানো অস্ত্র ইউক্রেনে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ হোক, এটা তারা চায় না। তাই তারা নিষেধাজ্ঞা মেনে রাশিয়ায় যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।
২০১৪ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০টির বেশি মাইক্রোচিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের আওতায় এসেছে। রাশিয়ায় যন্ত্রাংশ রপ্তানিতে এসব প্রতিষ্ঠানের আলাদা করে লাইসেন্স নিতে হয়। এমনকি সামরিক খাতে ব্যবহার করা হবে না, এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই পণ্য রপ্তানি করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিশ্রুতি মানেনি মস্কো। যার প্রমাণ, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে যাওয়া রুশ অস্ত্র।
আরইউএসআই বলছে, নিজেদের সমরাস্ত্র তৈরিতে অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আনা মাইক্রোচিপ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে রাশিয়া। তবে বিষয়টি বুঝতে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ বিলম্ব হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ক্রিমিয়ায় হস্তক্ষেপ করলেন, তারপর থেকে বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে পশ্চিমারা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন পুতিন। এই যুদ্ধে হাজারো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। চলমান যুদ্ধে রুশ বাহিনী ৩ হাজার ৬৫০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিল। এর মধ্যে পশ্চিমা যন্ত্রাংশে নির্মিত ৯এম৭২৭ ও খ–১০১ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। এতে যেমন বেসামরিক অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তেমনি ধ্বংস হয়ে গেছে শপিং সেন্টার, হাসপাতাল, স্কুলসহ অনেক বেসামরিক স্থাপনা। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদে মস্কোর ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে মাইক্রোচিপসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছে রাশিয়া। দেশটি ভেবেছিল, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সহজেই চিপ আনা যাবে। কিন্তু এসব দেশও যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে মস্কোর সঙ্গে চিপসহ যন্ত্রাংশ বাণিজ্য গুটিয়ে এনেছে। তাই বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। আরইউএসআই জানিয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ব্যবসায়ীরা চিপ আমদানিতে হংকংয়ের ওপর ঝুঁকেছেন। তবে এ বিষয়ে রাশিয়া এখনো কিছু জানায়নি।