২০২৩ সালটা অনেক উচ্চাশা নিয়ে শুরু করেছিল ইউক্রেন। দখল করা এলাকা উদ্ধারে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযান আশা দেখাচ্ছিল কিয়েভকে। কিন্তু সেই ‘আশার গুড়ে বালি’। বছরের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের ভূখণ্ড পুনর্দখল তো হয়নি, বরং যুদ্ধের ময়দানে বেশ কোণঠাসা ইউক্রেনের সেনারা।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে এখন রুশ বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই। এ নিয়ে খোদ সেনাপ্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় কমান্ডাররা অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন। আর এই অস্ত্রের ঘাটতি কবে পূরণ হবে, তা–ও এখন অনিশ্চিত।
যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদের ‘অব্যাহত’ সমর্থনেও ‘ফাটল’ ধরেছে। ‘কেন শত শত কোটি ডলার ইউক্রেনকে দেওয়া হবে’—এ প্রশ্ন উঠেছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। এ যুদ্ধে ‘ইউক্রেনের লক্ষ্য কী’, তা–ও জানতে চাইছেন অনেক দেশের নেতারা। আর এ কারণে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ায় ‘লাগাম টেনে ধরেছেন’ তাঁরা।
তবে বছরের শুরুতে পুতিনের রাশিয়াকে দেখে ‘ব্যাকফুটে’ আছে মনে হলেও দখল করা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে গত বছর অবস্থান সংহত করেছে রুশ বাহিনী। সম্মুখযুদ্ধে রুশ বাহিনীর সঙ্গে ‘পেরে ওঠা যাচ্ছে না’—এমন কথা বলছেন ইউক্রেনের সেনা কমান্ডাররাই। ইউক্রেনের ‘মনোবল ভাঙার’ কথাও উঠেছে।
বছরের শুরুতে পুতিনকে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হলেও এখন তিনি আত্মবিশ্বাসী। বছর শেষের সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, যে লক্ষ্যে এ যুদ্ধে ‘রাশিয়া জড়িয়েছে’, তাতে এখনো তারা অবিচল। এই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নয়।
বিবিসির ভাষ্যমতে, সবকিছু পরিকল্পনামতোই চলছে, এমন ‘মন্ত্র’ জপে বছর শুরু করেছিলেন পুতিন। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সব ঠিকঠাক চলছিল না। যুদ্ধের ময়দানে অনেক জায়গায় পিছু হটতে হচ্ছিল রুশ সেনাদের। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ও ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী গোষ্ঠী ভাগনারের মধ্যে বিরোধও প্রকাশ্য হয়ে উঠছিল তখন। যুদ্ধের মাঠে পিছিয়ে থাকায় পুতিনের জনপ্রিয়তাও দিন দিন কমেই চলেছিল।
তবে শুরুর দিকের ‘ভুল’ শুধরে নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় রাশিয়া। নতুন করে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড দখলের বদলে দখলে থাকা ভূখণ্ডে অবস্থান সংহত করার লক্ষ্য নেয়। তাই কিছু জায়গা ছাড়া বছরজুড়ে বড় ধরনের লড়াই হয়নি।
যদিও এ বছরই দেশে বড় একটি বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়েছিল পুতিনকে। ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের সশস্ত্র এই বিদ্রোহ পুতিনের ‘সর্বময়’ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। তবে ‘গোয়েন্দা পুতিন’ শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেছেন। অবশ্য এ জন্য নিজের সবচেয়ে অনুগত যোদ্ধাদের মধ্যে একজন প্রিগোশিনকে ‘কোরবানি’ দিতে হয়েছে তাঁকে।
এ ছাড়া যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। এ জন্য পুতিন এখন ‘রয়ে শয়ে’ আবার শুরুর করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী বছরের বাজেটে সামরিক খাতের জন্য রেকর্ড বরাদ্দ রেখেছেন। নিয়োগ দিচ্ছেন নতুন সেনা।
আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমরবিদেরা বলছেন, ইউক্রেন ও তাদের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে ‘অপেক্ষার খেলা’ খেলছেন পুতিন। তিনি ভালো করেই জানেন, সময় যত গড়াবে, পশ্চিমা সাহায্য–সহযোগিতা তত কমবে। আর এরই ‘ফায়দা’ তুলবে পরাশক্তি রাশিয়া। পুতিনের এই ধারণা স্পষ্ট, ‘একা ইউক্রেন’ তাঁর বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠবে না।
কিছুদিন ধরে পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও দিচ্ছেন। যদিও ইউক্রেন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে ‘মরণপণ’ লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিচ্ছেন। কারণ, এতে দখলে থাকা ভূখণ্ড রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর যুদ্ধে তাঁর ‘প্রাথমিক লক্ষ্য’ পূরণও হবে।
এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের ‘নারকীয়’ হামলা পুতিনের জন্য ‘বর’ হয়ে এসেছে। বিশ্বসম্প্রদায়ের নজর ইউক্রেন থেকে সরে পড়েছে গাজায়। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টাও চালাচ্ছেন পুতিন।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে দেশে–বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার ইউক্রেনের পক্ষেও কথা বলছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিমুখী আচরণকে ‘তুরুপের তাস’ করে পশ্চিমা বিশ্বকে প্রশ্নে জর্জরিত করছেন পুতিন। বলছেন, পশ্চিমারা তো ‘ভণ্ড’!
আগামী বছর রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে আবারও লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন পুতিন। আবারও পুতিনই যে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, সেই সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো লোক আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষমতা পোক্ত করার বন্দোবস্ত আগেই করে রেখেছেন পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এনবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধী মত দমনে ‘স্টার মার্ক’ পাওয়া পুতিনের বিপক্ষে শক্ত প্রার্থী যে কেউ নেই বা কাউকে ‘রাখা হবে না’, তা সবাই জানে। এরপরও নির্বাচনে পুতিনের জন্য বড় বিষয় হয়ে উঠবে যুদ্ধে রাশিয়ার ‘মান’ কতটা রাখতে পারলেন তিনি।
তবে পুতিন যে ‘আরামকেদারায়’ বসে দোল খাচ্ছেন, বিষয়টা এমনও নয়। নির্ভার অবস্থান ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। বছরজুড়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে ‘ঘাপটি’ মেরে থাকা রুশ সেনাদের তৎপর হতে বলেছেন তিনি।
পুতিনের নির্দেশমতো বছরের শেষ কয়েক দিনে কিয়েভসহ ইউক্রেনজুড়ে বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু করেছে রুশ বাহিনী। শব্দের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।
দারুণ চাঙা অবস্থায় থাকা পুতিন নতুন বছরে ইউক্রেনে হামলা আরও জোরদার করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ১৮ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন রুশ সেনারা। পুতিনের আপাত লক্ষ্য, তাঁদের দখলে থাকা এসব অঞ্চলে রাশিয়ার অবস্থান আরও পোক্ত করা।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুতিন ধারণা করেন, তিনি একাই পুরো পশ্চিমা বিশ্বকে ‘নাকাল’ করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য–সহযোগিতা যদি কমতে থাকে, তাহলে হয়তো একদিন তিনিই সত্য বলে প্রমাণিত হবেন।
পুতিনের জন্য ‘সোনায় সোহাগা’ হয়ে এসেছে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান শত্রু। তাই ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’—এ মন্ত্রের ফায়দা তুলেছেন পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বিদেশ থেকে রাশিয়া যেসব অস্ত্র ও সমরাস্ত্র প্রযুক্তি পেয়েছে, তা এ দুই দেশ থেকে এসেছে।
যুদ্ধ শুরুর দিকে ইরান থেকে সরাসরি ড্রোন পেলেও এখন তেহরানের দেওয়া প্রযুক্তিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশেই বিপুলসংখ্যক ড্রোন তৈরি করছে রাশিয়া। যুদ্ধের ময়দানে এখন রুশ সেনাদের ‘তুরুপের তাস’ হয়েছে উঠেছে এই ড্রোন।
যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছিল, তা প্রথমেই ধাক্কা খায় কিয়েভের উপকণ্ঠে ইউক্রেনীয় বাহিনীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এরপরই মূলত দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ক্রেমলিন। বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনের লক্ষ্যও ছিল, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে এগুলোর জোগান নিশ্চিত করা।
তবে সমরবিদেরা বলছেন, সমরাস্ত্র ও সৈন্যসামন্তে যতই এগিয়ে থাকুক, রাশিয়ার পক্ষে আরও একবার কিয়েভ দখলের চেষ্টা করার মতো অবস্থায় রাশিয়া নেই। কিয়েভ নয়, ইউক্রেনের বড় শহরগুলোর দখল নেওয়ারও সামর্থ্য নেই তাদের।
আল–জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, অপর দিকে ইউক্রেন বাহিনীর আরও একবার জোরালো পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই তাদের পশ্চিমা মিত্ররা। ফলে আগামী বছরও ইউক্রেনের বড় অভিযান চালানোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। মার্কিন আইনপ্রণেতারা যাতে কিয়েভের জন্য অর্থ ছাড় করেন, সেই তদবির চালাতে সম্প্রতি ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিন্তু নতুন করে অর্থ ও অস্ত্র পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস ছাড়া এখন পর্যন্ত তিনি তেমন কিছুই পাননি।
অস্ত্র–গোলাবারুদের সংকটে থাকা ইউক্রেন কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। কিয়েভের সাফল্য এখন পশ্চিমা সাহায্যেই নির্ভর করবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, কিয়েভের পাওয়া অর্থ–অস্ত্রের অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখাতে না পারলেও পুতিন দেশের অর্থনীতিকেও খাদের কিনারে যেতে দেননি। যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমাদের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে রুশ অর্থনীতি। দলে দলে পশ্চিমা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়া ছেড়েছে। তবে পরিস্থিতি সামলে উঠেছে রাশিয়া।
রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে ‘একঘরে’ করার যে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল পশ্চিমারা, তাতে পুতিনের ‘নাভিশ্বাস’ ওঠার শঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু ভারত ও চীন রাশিয়ার তেল–গ্যাস কিনে পুতিনকে আপাত ‘উদ্ধার করেছে’।
শেষ করছি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম দিয়ে। ব্রিটিশ কলাম লেখক জেরার্ড বেকারের কলামের শিরোনাম ছিল, ‘এ বছরের বিজয়ীরা: ভ্লাদিমির পুতিন, ইলন মাস্ক ও মার্কিন অর্থনীতি’। জেরার্ড বেকারের এমন বিশ্লেষণ দেখে মুচকি হেসে ২০২৩ সালকে বিদায় বলতেই পারেন পুতিন।