শোলেম শোয়াজবার্ড ইউক্রেনের একজন কবি। ইহুদিদের প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা ঈডিশে কবিতা লিখতেন তিনি। কবি হিসেবেই খ্যাতি পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু কবি পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন হত্যাকারী। তা–ও আরেক কবি ও সেনা কমান্ডারকে হত্যা করে।
ইউক্রেন সেনা কমান্ডার সায়মন ভাসিলিভোয়েচ পেতলিউরাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় পরপর পাঁচবার গুলি করে হত্যা করেন কবি শোয়াজবার্ড। পেতলিউরা ইউক্রেনের পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন। রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিকের নেতৃত্ব দেন তিনি।
কেন এমন হত্যাকাণ্ড ঘটল, তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে অনেকটা পেছনে। সেই ১৯১৮ সালের দিকে। গল্পটা ১৯২৬ সালের মে মাস পর্যন্ত।
১৯২৬ সালের ২৫ মে পেতলিউরাকে প্যারিসের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করেন শোয়াজবার্ড। সে সময় দুজনেই ইউক্রেন থেকে নির্বাসনে ছিলেন। প্রকাশ্যে বেলা সোয়া দুইটার দিকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। অনেকের সামনেই হয় হত্যাকাণ্ড। ১৭ মাস ধরে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলে। বিচারকাজ চলে ১৯২৭ সালের ১৮ থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত আট দিন ধরে। তবে দোষী সাব্যস্ত হননি শোয়াজবার্ড। এই হত্যাকাণ্ড, তদন্ত, খালাস ও বিচারকাজ সবই ছিল ইউরোপে ব্যাপকভাবে আলোচিত।
বিচারে দোষী না হলেও শোয়াজবার্ড গর্বের সঙ্গে বলতেন, তিনি ‘বড় হত্যাকারীকে’ হত্যা করেছেন। আর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই সে কাজ করতে পারায় গর্বও করতেন। এই নৈরাজ্যবাদী কবি কেন হত্যার পর এমন গর্ব করেছিলেন, তা বুঝতে হলে যেতে হবে আরও খানিকটা পেছনে।
কবি মানসিকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপ্লবের চিন্তায় তিনি এই কাজে থিতু হতে পারলেন না।
১৮৮৬ সালে আধুনিক ইউক্রেন ও তৎকালীন রাশিয়ার অধীন বেসারাবিয়া অঞ্চলের ইজমাইল এলাকায় জন্ম হয় শোয়াজবার্ডের। এই কবির জীবনী নিয়ে ২০১২ সালে পিএইচডি করেন কেলি জনসন। তাঁর গবেষণার তথ্য বলছে, ইজমাইলের কাছে বাল্টা এলাকায় শোয়াজবার্ডের যৌবনকাল কেটেছে। ১৮৮২ সালে ইহুদি হত্যাযজ্ঞের শুরুর সময়টায় বাল্টাতেই পালিয়ে যান তাঁর মা-বাবা।
শোয়াজবার্ডের জীবনটা কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর। সে সময় ইহুদি আইন নিয়ে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে হয়। কাজটা খুবই বিরক্তি নিয়ে করতেন শোয়াজবার্ড। কবি মানসিকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিপ্লবের চিন্তায় তিনি এই কাজে থিতু হতে পারলেন না।
পেতলিউরা ইউক্রেনের পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন। রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিকের নেতৃত্ব দেন তিনি।
১৬ বছর বয়সেই রাজনৈতিক অস্থিরতা শোয়াজবার্ডের ওপর প্রভাব ফেলে। প্রগতিশীল রাজনীতির মুখোমুখি পড়ে তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির অ-লেনিনবাদী শাখা মেনশেভিকে যুক্ত হন। তিনি আন্দোলন শুরু করেন। বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দেন। দলের অনুসারীদের চেয়ে তিনি ছিলেন আলাদা। ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহ এবং ইহুদি পরিচয় নিয়ে খুব বেশি সচেতনতার কারণেই এমনটা হয়েছিল। এই বোধ প্রভাব ফেলে তাঁর কর্মকাণ্ডেও।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ বাল্টায় ছড়িয়ে পড়ে ১৯০৫ সালে। সে সময় নিজ এলাকার ইহুদিদের সুরক্ষিত রাখতে তিনি সক্রিয় হন। আত্মজীবনী ‘ইন’ম লয়ফ ফান ইয়ার্নে’ (ইন দ্য টাইড অব টাইমস) শোয়াজবার্ড বর্ণনা করেছেন সে সময়টা। ৩০ থেকে ৪০ তরুণ ইহুদি তখন এক হয়েছিলেন। তাঁরা ঠিক করেছিলেন, ইহুদিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে হলে তাঁদের মরদেহের ওপর দিয়ে যেতে হবে।
তবে একটা পর্যায়ে শোয়াজবার্ডকে বাল্টা থেকে পালাতে হয়। কেলি জনসনের গবেষণা বলছে, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে শোয়াজবার্ড প্রচারকাজ চালাতে থাকেন। গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পর শোয়াজবার্ডকে কারাগারে নেওয়া হয়। এরপর তিনি রাশিয়া ছেড়ে নির্বাসনে যান।
নির্বাসনে থাকাকালেই তিনি নৈরাজ্যবাদী কবি হয়ে ওঠেন। তবে অর্থ চুরির ঘটনায় শোয়াজবার্ড আবারও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়।
৩০ থেকে ৪০ তরুণ ইহুদি তখন এক হয়েছিলেন। তাঁরা ঠিক করেছিলেন, ইহুদিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে হলে তাঁদের মরদেহের ওপর দিয়ে যেতে হবে।
জনসন মনে করেন, নির্বাসনকালে একাকিত্বের কারণেই শোয়াজবার্ড কবিতা চর্চায় উৎসাহিত হন। কারামুক্তির পর শোয়াজবার্ড ফ্রান্সের প্যারিসে যান। সেখানে তাঁর ভাই থাকতেন। ফ্রান্সে তিনি দেশটির সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত শাখা ফরেন লিজনে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করে বীর সেনা হিসেবে স্বীকৃতিও পান। যুদ্ধে আহত হওয়ার পরে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকলেও কবিতা লেখা বন্ধ হয়নি।
১৯২৪ সালে মোক্ষম সুযোগ হাতে আসে শোয়াজবার্ডের। পেতলিউরা সে বছর প্যারিসে যান। শোয়াজবার্ড খবর পান পেতলিউরা সেখানে একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেছেন। চলতে থাকে খোঁজ। সুযোগের অপেক্ষা।
এরপর প্যারিসে ফিরে সেখান থেকে ইউক্রেনে যান শোয়াজবার্ড। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সময় তিনি বিপ্লবের পক্ষের বাহিনীতে যোগ দেন। ইউক্রেনে শোয়াজবার্ড ইহুদিদের হত্যাযজ্ঞ দেখেন। ঐতিহাসিক জেফরি ভেইডলিনজার ‘ইন দ্য মিডস্ট অব সিভিলাইজড ইউরোপ’ বইয়ে বলেছেন, কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রকৃত সংখ্যা কখনই জানা যাবে না। তবে সাত লাখের বেশি মানুষ এই সহিংসতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ইহুদিযজ্ঞে অনেক স্বজন হারান শোয়াজবার্ডও। ফ্রান্সে ফিরে এসে শোয়াজবার্ড ব্যবসা শুরু করেন। বামপন্থী পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করেন তিনি।
১৯২৪ সালে মোক্ষম সুযোগ হাতে আসে শোয়াজবার্ডের। পেতলিউরা সে বছর প্যারিসে যান। শোয়াজবার্ড খবর পান পেতলিউরা সেখানে একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেছেন। চলতে থাকে খোঁজ। সুযোগের অপেক্ষা। ১৯২৬ সালের ২৫ মে ফ্রান্সের রেসিন এলাকায় দুজন মুখোমুখি হন। পাঁচটি গুলি করে পেতলিউরাকে হত্যা করেন শোয়াজবার্ড।
ইহুদিদের রক্ষাকারী হিসেবে পরিচিত অ্যাটর্নি হেনরি টর শোয়াজবার্ডের হয়ে আইনি লড়াই চালান। এক সপ্তাহ ধরে বিচারকাজ চলার পর যথাযথ প্রমাণ না পাওয়ায় শোয়াজবার্ডকে আদালত নির্দোষ ঘোষণা করেন।
শোয়াজবার্ড ফ্রান্সের একটি গ্রামে বাকি জীবনটা কাটান। সেখানে তিনি খামার চালাতেন। ইনস্যুরেন্স ব্যবসা করতেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন। ইহুদি ও নৈরাজ্যবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন ভ্রমণের সময় ৫১ বছর বয়সে শোয়াজবার্ড মারা যান।
ঈডিশ লেখক স্যামুয়েল চার্নি বলছেন, শোয়াজবার্ড কখনই তাঁর কবিতাকে অস্ত্র করে তোলেননি। শোয়াজবার্ড একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতা লিখতেন। কবিতাকে তিনি সেই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করেছেন। আর সেই উদ্দেশ্য পূরণ করেই তিনি কুখ্যাত হয়েছেন বলে মনে করেন এই লেখক।
এরপর থেকে শোয়াজবার্ডের নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে যায় হত্যাকারী হিসেবে। কিন্তু তাঁর কবি পরিচয়ের কী হলো? ঈডিশ লেখক স্যামুয়েল চার্নি বলছেন, শোয়াজবার্ড কখনই তাঁর কবিতাকে অস্ত্র করে তোলেননি। শোয়াজবার্ড একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতা লিখতেন। কবিতাকে তিনি সেই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করেছেন। আর সেই উদ্দেশ্য পূরণ করেই তিনি কুখ্যাত হয়েছেন বলে মনে করেন এই লেখক।
(তথ্যসূত্র: আমেরিকান সমাজতান্ত্রিক সাময়িকী জ্যাকোবিন, অনলাইন লাইব্রেরি অ্যান্ড পাবলিকেশন প্ল্যাটফর্ম , অ্যামাজন ডটকম)