২২ জুন ১৯৪১। এদিন অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি তিন লাখ সৈন্যের এক বিশাল বহর নিয়ে তিন দিক থেকে একযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। লক্ষ্য, দ্রুত সোভিয়েতের পূর্বাঞ্চল দখল করে মস্কোর কাছে চলে আসা। উত্তর থেকে বাল্টিক ফ্রন্ট, দক্ষিণে ইউক্রেন এবং মধ্যাঞ্চলে স্মলেনস্ক ও মস্কো। হিটলারকে ঠেকাতে তাঁর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছিলেন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন। তাঁর ধারণা ছিল জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করবে না। তাঁর সেই ভ্রান্ত ধারণার বড় খেসারত দিতে হয় সোভিয়েত জনগণকে। তিন ফ্রন্টেই সহজে সাফল্য পায় জার্মান বাহিনী। কিয়েভ ও স্মলেনস্ক জার্মানির দখলে চলে আসে। লেনিনগ্রাদকে তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, লক্ষ্য গলা টিপে এই শহর ও তার নাগরিকদের মেরে ফেলা।
৮০ বছর পর সেই একই ফ্রন্ট। এবার প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে রুশ বাহিনীকে। এ প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউক্রেনের পার্তিজানরা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আশা ছিল, তাঁর বাহিনী দ্রুত কিয়েভ দখলের পর এক তাবেদার সরকার গঠন করে ঘরে ফিরে যাবে। তিনি ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের কথা মাথায় রাখেননি, ইউক্রেনীয় পার্তিজানদের ভূমিকাও হিসাবে রাখেননি। এখন সে ভুলের জন্য তাঁকে মাসুল দিতে হচ্ছে।
কিন্তু হিসাবে একটা ভুল করেছিল হিটলার ও তাঁর সেনাবাহিনী। সোভিয়েত জনগণের মুক্তির স্পৃহা এবং গেরিলা প্রতিরোধক্ষমতা তারা ঠাহর করতে পারেনি। পার্তিজান নামে পরিচিত এই গেরিলাযোদ্ধারা শত্রুব্যূহের ভেতরে থেকে চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালিয়ে জার্মানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে। বেলারুশ ও ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে আবার মিলিয়ে যেত তারা। ব্যাপারটা এমন ভীতিকর হয়ে ওঠে যে পূর্ব ফ্রন্টের জার্মান সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল গুন্টার ভন ক্লুগ স্বীকার করতে বাধ্য হন, গেরিলাযোদ্ধাদের আক্রমণে তাঁরা বড় ধরনের বিপদের মুখে রয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এরা ক্রমেই এতটা সাহসী হয়ে উঠছে যে আমাদের সৈন্যরা মানসিকভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়ছে। এরা কখন কোথা থেকে হামলা চালাবে, আমরা জানি না। ফলে জার্মান সৈন্যদের ঘুম হারাম হচ্ছে।’
এই যুদ্ধ কেবল রাশিয়া বনাম ইউক্রেন নয়, তা এখন রাশিয়া বনাম পশ্চিমা বিশ্ব। ওয়াশিংটন খোলামেলাভাবেই বলেছে, রাশিয়া পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত অথবা পুতিনের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ইউক্রেনের একার ক্ষমতা নেই রাশিয়াকে টলায়। পার্তিজানদের পক্ষে আঁচড় দেওয়া সম্ভব, রুশদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়।
৮০ বছর পর সেই একই ফ্রন্ট। এবার প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে রুশ বাহিনীকে। এ প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইউক্রেনের পার্তিজানরা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আশা ছিল, তাঁর বাহিনী দ্রুত কিয়েভ দখলের পর এক তাবেদার সরকার গঠন করে ঘরে ফিরে যাবে। তিনি ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের কথা মাথায় রাখেননি, ইউক্রেনীয় পার্তিজানদের ভূমিকাও হিসাবে রাখেননি। এখন সে ভুলের জন্য তাঁকে মাসুল দিতে হচ্ছে।
হিটলার বাহিনীর মতো পুতিনের বাহিনীও মহাপরাক্রমশালী। ইউক্রেনের তুলনায় তারা সংখ্যায় ও অস্ত্রশস্ত্রে বহুগুণ শক্তিশালী। রয়েছে অত্যাধুনিক বিমানবহর ও নৌবাহিনী। আরও রয়েছে ছোট-বড় নানা পারমাণবিক অস্ত্র। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের এক সপ্তাহের বেশি টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা কেবল টিকেই নয়, পাল্টা আঘাতে রুশ বাহিনীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। জার্মান বাহিনীর মতোই রুশরাও পূর্ব ও দক্ষিণ ফ্রন্টে বেশ এলাকাজুড়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখন তা ধরে রাখতে তাদের মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। সবচেয়ে বড় বিপদ সেই পার্তিজানদের নিয়ে, যারা ৮০ বছর আগে জার্মানদের নাস্তানাবুদ করেছিল। সে কথার স্বীকৃতি এসেছে খোদ রুশ জেনারেলদের কাছ থেকেই।
মস্কোর সেন্সরের বজ্র আঁটুনি ফসকে যুদ্ধের সত্যি খবর আসা অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট পুতিন যাতে ক্ষিপ্ত না হন, সে জন্য রুশ গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ‘গোলাপি’ চিত্রই দিয়ে এসেছে। তারাও বলছে, রণাঙ্গনে বড় ধরনের ‘নাশকতামূলক’ তৎপরতা চলছে। গত সপ্তাহে ক্রিমিয়ার একটি প্রধান রুশ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনীয় হামলায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এ কথা জানিয়েছে কমসোমলস্কাইয়া প্রাভদা। একজন রুশ সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইউক্রেনের নাশকতামূলক কার্যকলাপের ফলে একটি গোলাবারুদের ডিপোতে আগুন ধরে গেছে, তবে প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সত্যিটা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। স্যাটেলাইটের ধারণকৃত ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, ক্রিমিয়ার সাকি বিমানঘাঁটিতে যে হামলা হয়, তাতে অন্ততপক্ষে আটটি রুশ সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। বেসরকারি স্যাটেলাইট কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবের ধারণকৃত ছবি দেখে এ কথা নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ইউক্রেনীয় সূত্রে বলা হয়েছে, কম করে হলেও ১০০ রুশ সৈন্য ইউক্রেনীয় পার্তিজানদের হামলায় ঘায়েল হয়েছেন। অধিকৃত ক্রিমিয়ার একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘শুধু এটুকু বলতে পারি, নভোফেদোরিভকা বিমানঘাঁটির ওপর হামলার ফলে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।’
এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে ইউক্রেনীয় গেরিলারা। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, দক্ষিণ ইউক্রেনের অধিকৃত মেলিতোপোল এখন পার্তিজান তৎপরতার ‘সদর দপ্তর’। রুশ সৈন্যদের ওপর চোরাগুপ্তা হামলা তো রয়েছেই, তদুপরি রয়েছে রুশ পরিবহনব্যবস্থার ওপর হামলা, অস্ত্রের গুদামে হামলা, সৈন্য বহনরত গাড়ির ওপর বোমা হামলা। পত্রিকাটি এসব হামলার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, সেটা অনেকটা এ রকম: ‘১৮ মে, সামরিক ট্রেন ও কমান্ডক্ষেত্রের ওপর হামলা। ২২ মে, রেলওয়ে লাইন ও রাডার স্টেশন ধ্বংস। ৩০ মে, বোমায় এক দালালের বাড়ি ধ্বংস। একই সময় মেলিতোপোলে পার্তিজান হামলায় ১০০ জনের মতো রুশ সৈন্য ঘায়েল।’ একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী খেরসনে। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, এখানে রুশনিয়ন্ত্রিত বিমানছাউনিতে কম করে হলেও এক ডজন হামলা হয়েছে। এনেরহোদার শহরে দালাল মেয়র আন্দ্রেই শেভচিকের জীবননাশের চেষ্টা হয়েছে। এক রুশ সৈন্য ও তাঁর বান্ধবীর টেলিফোন কথোপকথন থেকে জানা গেছে, অধিকৃত ইজুমে এক নারীর কাছ থেকে বিষাক্ত পিঠা খেয়ে আটজনের মতো রুশ সৈন্য মারা গেছেন। চারদিকে (পার্তিজান হামলায়) অকেজো হওয়া ট্যাংক পড়ে আছে, কোনো কোনোটা ইউক্রেনীয় কৃষকেরা টেনে যাঁর যাঁর খেতে নিয়ে যাচ্ছেন। দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে অস্ত্রগুদামে অগ্নিকাণ্ডের খবরও এসেছে।
দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসে বিবিসির সারাহ রেইনফোর্ড জানিয়েছেন, এসব গেরিলাযোদ্ধা ‘ছায়া’র মতো, তাদের চোখে দেখা যায় না, অথচ এদের হামলায় জেরবার হয়ে পড়ছে রুশ বাহিনী। শুধু চোরাগুপ্তা হামলা নয়, আধুনিক ড্রোন হামলাতেও এরা বিশেষজ্ঞ। এরা কেউ সেনাসদস্য নয়, পেশাদার কর্মজীবী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাঁদা তুলে নিজেদের খরচ নির্বাহ করছে।
এই পার্তিজানদের একটি প্রধান লক্ষ্য রুশ বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতারত ইউক্রেনীয় দালাল (‘রাজাকার’) নিধন। সারাহ একটি বিলবোর্ডের কথা জানিয়েছেন, সেখানে মুখ ঢাকা এক পার্তিজানের ছবির নিচে বড় অক্ষরে লেখা, ‘সাবধান, পার্তিজানরা সবকিছুর ওপর নজর রাখছে।’
নিউইয়র্ক টাইমস–এর ইয়ানা দিলুগিও খেরসন ঘুরে এসে পার্তিজানদের ভূমিকার সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন। সরাসরি যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে তারা পেরে উঠবে না—এ কথা ইউক্রেনীয় সেনা নেতৃত্ব আগে থেকেই জানতেন। তাই যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই তাঁরা প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে গেরিলাদের নাশকতা কার্যকলাপে প্রশিক্ষণ দেন। একজন ইউক্রেনীয় গেরিলার উদ্ধৃতি দিয়ে দিলুগি জানান, দখলদার বাহিনী নির্মূল করা গেরিলাদের লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য তাদের মনে ভয় ধরানো। সে লক্ষ্য অর্জনে ইউক্রেনীয় গেরিলাযোদ্ধারা অনেকাংশেই সফল বলে জানাচ্ছেন দিলুগি।
পাভেল ফিলাতায়েভ নামের এই সৈনিকের ভাষ্য অনুযায়ী, রুশ সৈন্যদের মনে এতটাই ভীতির সঞ্চার হয়েছে যে তারা সামরিক দায়িত্ব পালন এড়াতে নিজেরাই নিজেদের পায়ে গুলি লাগিয়ে আহত হয়ে পড়ছে। যুদ্ধে আহত হলে ৩০ লাখ রুবল ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে, সেটাও নিজেদের পায়ে গুলি করার আরেক কারণ।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ও গেরিলাদের তৎপরতায় রুশ সেনাসদস্যদের মনে কী পরিমাণ ভীতির সঞ্চার হয়েছে, তার উদাহরণ হিসেবে সামরিক তথ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘নাইনটিন ফোরটি ফাইভ’ একজন দলত্যাগী রুশ সৈন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি ও স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছে। পাভেল ফিলাতায়েভ নামের এই সৈনিকের ভাষ্য অনুযায়ী, রুশ সৈন্যদের মনে এতটাই ভীতির সঞ্চার হয়েছে যে তারা সামরিক দায়িত্ব পালন এড়াতে নিজেরাই নিজেদের পায়ে গুলি লাগিয়ে আহত হয়ে পড়ছে। যুদ্ধে আহত হলে ৩০ লাখ রুবল ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে, সেটাও নিজেদের পায়ে গুলি করার আরেক কারণ।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজি প্রবল তিক্ততার সঙ্গে স্মরণ করেছেন, জান বাজি রেখে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর জন্যই তাঁদের পিছু হটতে হয়েছে। এরাই ভারতীয় বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা কেবল সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, তারা গভীরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। যত সময় গেছে, তাদের মনোবল ততই দৃঢ় হয়েছে। (এ এ কে নিয়াজি, দ্য বিট্রায়াল অব ইস্ট পাকিস্তান)।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক স্টাডি অব ওয়ার মনে করে, পূর্বে ও দক্ষিণে রুশ বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলার জন্য ইউক্রেন যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার অংশ হিসেবেই অধিকৃত এলাকায় গেরিলা তৎপরতা বেড়ে গেছে। গেরিলাদের এই সাফল্য ইউক্রেনীয় সৈনিকদের মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ার ওপর চলতি হামলা থেকে বোঝা যায়, ইউক্রেনীয়রা শুধু চলতি যুদ্ধে রুশ বাহিনীর হাতে দখল করা জমি নয়, আগের দখল করা সীমানাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। সে কথার প্রমাণ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মন্তব্যে, ‘রুশদের মনে রাখতে হবে, ক্রিমিয়া আমাদের, রাশিয়ার নয়।’
সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় সাফল্যের কারণেই দক্ষিণ ও পূর্ব রণাঙ্গনে রুশ বাহিনী থমকে আছে। পেন্টাগন থেকে বলা হয়েছে, কম করে হলেও ৮০ হাজার রুশ সৈন্য ইতিমধ্যে হতাহত হয়েছে। বাধ্য হয়েই রণাঙ্গনে যুদ্ধ–প্রস্তুত সৈনিকের খোঁজে মস্কো সিরিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে।
এই যুদ্ধ কেবল রাশিয়া বনাম ইউক্রেন নয়, তা এখন রাশিয়া বনাম পশ্চিমা বিশ্ব। ওয়াশিংটন খোলামেলাভাবেই বলেছে, রাশিয়া পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত অথবা পুতিনের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ইউক্রেনের একার ক্ষমতা নেই রাশিয়াকে টলায়। পার্তিজানদের পক্ষে আঁচড় দেওয়া সম্ভব, রুশদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেই হিসাব থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে সর্বাধুনিক সমর সরঞ্জাম সরবরাহ করে চলেছে। আফগান যুদ্ধে সোভিয়েতদের কাবু করেছিল কাঁধে রেখে তাক করা স্টিংগার ক্ষেপণাস্ত্র। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাইমারস রকেট লঞ্চার। যেকোনো সাধারণ ট্রাকের ওপর বসিয়ে একই সঙ্গে একাধিক রকেট নিক্ষেপযোগ্য এসব লঞ্চার স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত। লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে একবার নিক্ষিপ্ত হলে সে রকেট তার ‘টার্গেট’ ধরাশায়ী করবেই। সর্বশেষ যে সমরাস্ত্র প্রেরণের কথা যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, তাতে হাইমারস ছাড়াও অত্যাধুনিক ড্রোন, দ্রুতগতিসম্পন্ন অ্যান্টিরেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র ও ওয়্যারলেস পরিচালিত ‘টো’ ক্ষেপণাস্ত্র।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় সাফল্যের কারণেই দক্ষিণ ও পূর্ব রণাঙ্গনে রুশ বাহিনী থমকে আছে। পেন্টাগন থেকে বলা হয়েছে, কম করে হলেও ৮০ হাজার রুশ সৈন্য ইতিমধ্যে হতাহত হয়েছে। বাধ্য হয়েই রণাঙ্গনে যুদ্ধ–প্রস্তুত সৈনিকের খোঁজে মস্কো সিরিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের মোটা বেতনে চাকরিতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহকারী ওয়াগনার কোম্পানি এত দিন বেনামে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর পাশে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছিল। সম্প্রতি তারা ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজ বেশে বেরিয়ে এসেছে। ক্রেমলিন-সমর্থিত ‘টেলিগ্রাম’ ব্লগে জানানো হয়েছে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যেসব স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তারা আর কেউ নয়, ওয়াগনার কোম্পানির লোক। এদের একজন হলেন ২০১৩ সালে অযোগ্যতার কারণে রুশ বিমানবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কানামাত বতাশেভ। ইউক্রেনের আকাশে যুদ্ধবিমান চালনার সময় নিহত হলে ওয়াগনার নিজেই তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে বতাশেভের মৃত্যুর খবর জানায়।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভাড়াটে সেনা ব্যবসার জন্য কুখ্যাত এই কোম্পানির মালিক পুতিনের নিকটবন্ধু বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইভগেনি প্রিগোজিন। তথ্যানুসন্ধানী রুশ ওয়েবসাইট মেদুজা জানিয়েছে, নানা কারণে একসময় পুতিন ও প্রিগোজিনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের প্রয়োজনেই এখন পুতিন সে বিবাদ মিটিয়ে নিয়েছেন।
অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, জর্জিয়ার আবখাজিয়া বা মলদোভার ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার মতো অধিকৃত দনবাস ও ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল আরেকটি ‘হিমায়িত যুদ্ধে’ পরিণত হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী লেনিনগ্রাদ শহর ৯০০ দিন অবরোধ করে ছিল। এবারও সে ঘটনা ঘটতে পারে।
ইতিমধ্যে ছয় মাস কেটে গেছে। ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখে রুশ অগ্রগতি মন্থর হয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, জর্জিয়ার আবখাজিয়া বা মলদোভার ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার মতো অধিকৃত দনবাস ও ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চল আরেকটি ‘হিমায়িত যুদ্ধে’ পরিণত হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী লেনিনগ্রাদ শহর ৯০০ দিন অবরোধ করে ছিল। এবারও সে ঘটনা ঘটতে পারে।
এ কথা ঠিক, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অর্থনীতি ক্রমেই চিড়েচ্যাপটা হয়ে আসছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা নিজে সে কথা স্বীকার করেছেন। দেশটি এখনো তেল-গ্যাস বিক্রি করে চলেছে, ফলে শিগগির সে মুখ থুবড়ে পড়বে না, নাবিউলিনা সে আশ্বাসও দিয়েছেন। পুতিন এই যুদ্ধকে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার ‘অস্তিত্বের লড়াই’ বলে উপস্থিত করে জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিয়েছেন। ফলে দেশের ভেতরে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। শিগগির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মুখে পড়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হবেন—সে কথা ভাবারও আশু কোনো কারণ নেই।
ওরা ইউক্রেনে আমাদের লাশের মিছিল বসিয়েছে। আমি এই উন্মত্ততায় আর অংশ নিতে পারি না।পাভেল ফিলাতায়েভ, আহত রুশ সৈনিক
একটি আশার আলো দেখাচ্ছেন পাভেল ফিলাতায়েভের মতো সাহসী সৈনিক। এই আহত রুশ সৈন্যের যে স্মৃতিকথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এখন রুশ ভাষায় জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ভকন্টাক্তে মুদ্রিত হওয়ার পর রাশিয়ার ভেতরে তা দারুণ সাড়া ফেলেছে। কেন এই যুদ্ধ, সে যুদ্ধের বাস্তব চিত্রটি কী, ক্রেমলিনের কঠোর সেন্সরের কারণে অধিকাংশ রুশের কাছে তা অজ্ঞাত। ফিলাতায়েভ তাতে সামান্য হলেও আলো ফেলেছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘ওরা ইউক্রেনে আমাদের লাশের মিছিল বসিয়েছে। আমি এই উন্মত্ততায় আর অংশ নিতে পারি না।’
এদের সংখ্যা যত বাড়বে, বন্দুকের নল থেকে পুতিনের আঙুল ততই শিথিল হবে।
২২ আগস্ট ২০২২, নিউইয়র্ক