গত বছরের অক্টোবর মাস। ফেসবুকে ভারতের কেরালা রাজ্যের বাসিন্দা ডেভিড মুথাপ্পানের চোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। রাশিয়ায় নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ছিল সেটি। বেতন মাসে ২ লাখ ৪ হাজার রুবল। বাংলাদেশের হিসাবে যা প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
স্কুলে থাকতেই পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছিল মুথাপ্পানকে। তাই চাকরির বিজ্ঞাপনে বেতনের অঙ্ক মনে ধরেছিল তাঁর। রাজি হয়ে যান তিনি। কয়েক সপ্তাহ বাদেই ২৩ বছর বয়সী মুথাপ্পানের জায়গা হয় ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে। সে সময় দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সব জায়গায় ছিল মৃত্যু আর ধ্বংসের ছায়া।’
দিন কয়েক আগে মুথাপ্পান ও কেরালার আরেকজন ভারতে ফিরতে পেরেছেন। শুধু তাঁরাই নন, আরও কয়েকজন ভারতীয়কে দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নামতে হয়েছে। অনেকেই এখনো রাশিয়া থেকে ফিরতে পারেননি। যুদ্ধে মারা গেছেন অন্তত দুজন। দরিদ্র এই মানুষগুলোকে চাকরি, কখনো–বা রুশ বাহিনীর ‘সহযোগী’ হিসেবে কাজ করার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, প্রতারণা করে যেসব ভারতীয়কে ইউক্রেনে যুদ্ধের ময়দানে নামানো হয়েছে, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে ‘রুশ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হচ্ছে’। গত সপ্তাহে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিষয়টিকে ‘ভারতের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
মুথাপ্পানের বাড়ি কেরালার পোঝিউর গ্রামে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজ মাটিতে ফিরতে পেরে এখন স্বস্তিতে রয়েছেন তিনি। তবে যুদ্ধের ময়দানে থাকার দিনগুলোর কথা ভুলতে পারছেন না। মুথাপ্পান বলেন, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। এটা দেখে তিনি বমি করতে করতে প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। পরে তাঁদের নেতৃত্বে থাকা রুশ কমান্ডার তাঁকে চৌকিতে ফিরে যেতে বলেন।
রাশিয়ার ভিসার জন্য ওই দালালকে জনপ্রতি ৭ লাখ রুপি করে দিয়েছিলেন সেবাস্তিয়ান ও তাঁর বন্ধুরা। এ বছরের ৪ জানুয়ারি তাঁরা মস্কো পৌঁছান।
গত ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের সময় লড়াই করতে করতে পা ভেঙেছিল মুথাপ্পানের। তবে এ ঘটনার কথা সে সময় পরিবারকে জানাননি তিনি। পা ভাঙার পর আড়াই মাস তাঁকে লুহানস্ক, ভলগোগ্রাদ ও রোস্তভের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিল।
গত মার্চ মাসে এক দল ভারতীয় মুথাপ্পানকে মস্কোয় ভারতের দূতাবাসে যেতে সহায়তা করেন। পরে দূতাবাসের সহায়তায় ভারতে ফেরেন তিনি। একইভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভারতে ফিরতে পেরেছেন প্রিন্স সেবাস্তিয়ান। তাঁর বাড়ি মুথাপ্পানের গ্রাম থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে, আনচুথেঙ্গু গ্রামে।
স্থানীয় এক দালালের খপ্পরে পড়ে সেবাস্তিয়ানকে যেতে হয়েছিল পূর্ব ইউক্রেনে মস্কো নিয়ন্ত্রিত লিসিচানস্ক শহরে। সেখানে মোতায়েন করা ৩০ জন যোদ্ধার একটি দলে ছিলেন তিনি। মাত্র তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পর তাঁকে যুদ্ধের সম্মুখসারিতে পাঠানো হয়েছিল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল রকেট লঞ্চার ও বোমার মতো ভারী অস্ত্র। ফলে দ্রুত চলাচলও করতে পারতেন না তিনি।
যুদ্ধের সম্মুখসারিতে পৌঁছানোর পর কাছ থেকে ছোড়া একটি গুলি এসে সেবাস্তিয়ানের বাঁ কানের নিচে লাগে। তিনি পড়ে যান। পরে বুঝতে পারেন, শরীরের নিচে রয়েছে এক রুশ সেনার মরদেহ। সেবাস্তিয়ান বলেন, ‘আমি বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। এক ঘণ্টা পর রাত নামলে আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ হলো। এতে আমার বাঁ পায়ে বেশ আঘাত পেলাম।’
সেই রাতটা একটি পরিখায় কাটান সেবাস্তিয়ান। রক্ত ঝরছিল। পরদিন সকালে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। এরপর বেশ কয়েক সপ্তাহ ভর্তি থাকতে হয় হাসপাতালে। বিশ্রামের জন্য ছুটি পান এক মাস। এই সময়টাতে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁকে সহায়তা করেন একজন ধর্মযাজক। পরে দূতাবাসের সহায়তায় ভারতে ফেরেন তিনি।
সেবাস্তিয়ান জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন আরও দুই বন্ধু। ওই দুজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁদের খোঁজখবর পাচ্ছে না তাঁদের পরিবারও। কেরালার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা মুথাপ্পান, সেবাস্তিয়ান ও তাঁর দুই বন্ধুর দালালের খপ্পরে পড়ার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছেন।
কীভাবে এই দালালের খপ্পরে তাঁরা পড়েছিলেন, সে গল্প বলছিলেন সেবাস্তিয়ান। ইউরোপে চাকরির খোঁজে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা স্থানীয় এক দালালের কাছে গিয়েছিলেন। ওই দালাল বলেছিলেন, রাশিয়ায় নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করাটা তাঁদের জন্য একটি ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হবে। বেতন পাওয়া যাবে মাসে ২ লাখ রুপি। দালালের কথায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান তাঁরা।
সেবাস্তিয়ান এখন ভারতে তাঁর পুরোনো পেশা মাছ ধরা শুরু করেছেন। রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য যে অর্থ ধার করেছিলেন, এখন তা শোধ করতে হবে তাঁকে।
রাশিয়ার ভিসার জন্য ওই দালালকে জনপ্রতি ৭ লাখ রুপি করে দিয়েছিলেন সেবাস্তিয়ান ও তাঁর বন্ধুরা। এ বছরের ৪ জানুয়ারি তাঁরা মস্কো পৌঁছান। নিজেকে অ্যালেক্স পরিচয় দেওয়া একজন ভারতীয় দালাল সেখানে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিলেন।
সে রাতটা একটি বাসায় কাটিয়েছিলেন সেবাস্তিয়ান ও তাঁর বন্ধুরা। পরদিন এক ব্যক্তি তাঁদের রাশিয়ার কস্ত্রোমা শহরে একজন সেনা কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যান। সেখানে তাঁদের একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে দেওয়া হয়। তবে রুশ ভাষায় লেখা চুক্তিটির বিষয়বস্তু কিছুই বুঝতে পারেননি তাঁরা।
সেখানে তিন বন্ধুর সঙ্গে যোগ দেন শ্রীলঙ্কার তিন নাগরিক। তারপর ছয়জনকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউক্রেন সীমান্তের রোস্তভ অঞ্চলের একটি সামরিক ক্যাম্পে। নিয়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট ও মুঠোফোন। ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় তাঁদের প্রশিক্ষণ। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁরা শিখে যান, কীভাবে ট্যাংকবিধ্বংসী গ্রেনেড ব্যবহার করতে হয়। আর আহত হলে কী করতে হবে, তা–ও শেখানো হয়।
এরপর ছয়জনকে অ্যালাবিনো পলিগন নামের আরেকটি ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁদের টানা ১০ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেবাস্তিয়ান বলেন, ‘সেখানে আমাদের জন্য সব ধরনের অস্ত্র ছিল। সেগুলো নিয়ে খেলনার মতো মজা করা শুরু করলাম।’ তবে সে আনন্দ বেশিক্ষণ থাকেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা।
সেবাস্তিয়ান এখন ভারতে তাঁর পুরোনো পেশা মাছ ধরা শুরু করেছেন। রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য যে অর্থ ধার করেছিলেন, এখন তা শোধ করতে হবে তাঁকে। চান নতুনভাবে জীবন শুরু করতে। একই ইচ্ছা মুথাপ্পানেরও। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া যাওয়ার আগে একজনের সঙ্গে আমার বাগদান হয়েছিল। তখন বলেছিলাম, রাশিয়া থেকে অর্থ নিয়ে আসব। আর বিয়ের আগে একটা বাড়ি বানাব।’
মুথাপ্পান ও তাঁর বাগ্দত্তাকে এখন নতুন করে নিজেদের গুছিয়ে নিতে হবে। বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দুই বছর। তবে অন্তত এটুকু মনে করে তিনি স্বস্তি পান যে যুদ্ধের সময় তাঁর প্রাণটা যায়নি। মুথাপ্পান বলছিলেন, ‘একদিন ইউক্রেনীয় সেনারা আমাদের চেয়ে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ছিলেন। তখনো আমাদের হামলা চালিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। তবে আমি একটি গুলিও করিনি। আমি কাউকে হত্যা করতে পারব না।’