রাশিয়ার তেল-গ্যাস ছাড়া পশ্চিমারা কি চলতে পারবে

রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর বড় ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের প্রধান একটি পাইপলাইন এখনো বন্ধ করে রেখেছে রাশিয়া। এতে ইউরোপের বেশ কয়টি দেশে গ্যাসের জোগান মারাত্মকভাবে কমে গেছে।

জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপ। এখন রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় ইউরোপে জ্বালানির দাম আরও বেড়েছে। এ কারণে সংকট আরও গভীর হয়েছে।

রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর বড় ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে পশ্চিমারা। রাশিয়ার তেল-গ্যাস ছাড়া পশ্চিমারা কি চলতে পারবে, তা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।

পশ্চিমাদের ব্যবহার করা গ্যাসের কতটা রাশিয়ার

গত বছর রাশিয়া তার উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোকে সরবরাহ করে। গত বছর রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানি। দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানিকারক ছিল ইতালি।

২০২১ সালে মোট চাহিদার ৪ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে যুক্তরাজ্য। তবে গত জুন পর্যন্ত পরপর তিন মাস রাশিয়া থেকে কোনো গ্যাস আমদানি করেনি দেশটি। আর রাশিয়া থেকে একেবারেই গ্যাস কেনে না যুক্তরাষ্ট্র।
ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে গ্যাস সরবরাহ আটকে দেওয়াটা একটা ধাক্কা হিসেবে এসেছে। কারণ, রাশিয়া গ্যাসের সরবরাহ আটকে দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে গ্যাসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

নর্ড স্ট্রিম-১ নামের পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম বলছে, এই পাইপলাইনে ছিদ্র হয়েছে। তাই এটি দিয়ে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে।

নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন যেখান থেকে শুরু হয়েছে, তার কাছাকাছি একটি প্ল্যান্টে থাকা বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়িয়ে ফেলছে গাজপ্রম। তারা গ্যাস কেন পোড়াচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।

গ্যাস বন্ধের পেছনে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এখন ক্রেমলিন বলছে, পশ্চিমা এই নিষেধাজ্ঞার জেরে কিছু ‘প্রযুক্তিগত সমস্যা’ দেখা দিয়েছে। এ কারণে পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহে বাধার মুখে পড়েছে রাশিয়া।

রাশিয়ার একটি গ্যাস টারবাইন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। টারবাইনটি কানাডায় মেরামত করে জার্মানিতে পাঠানো হয়। কিন্তু সেটি ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায় মস্কো। মস্কোর ভাষ্য, টারবাইনটি ফেরত না নেওয়ার সঙ্গে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি রয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারির শেষভাগ থেকে রাশিয়ার জ্বালানি খাতকে নিশানা করে ইইউ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, জ্বালানিশিল্পে ব্যবহার করা হয়—এমন সরঞ্জাম, প্রযুক্তি ও সেবা ইইউর দেশগুলো থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি করা যাবে না।

তবে গ্যাস টারবাইন ফেরত না নেওয়ার পেছনে রাশিয়া যে কারণ দেখিয়েছে, তা যৌক্তিক নয় বলে জানিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন।

কমিশন বলছে, মস্কোর ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জার্মানি থেকে রাশিয়ায় গ্যাস টারবাইন সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে না।

টারবাইন-সংক্রান্ত জটিলতার জন্য ‘সিমেন্স এনার্জি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকেও অভিযুক্ত করেছে গাজপ্রম। সিমেন্স এনার্জি টারবাইন তৈরি করে। গাজপ্রমের অভিযোগ, টারবাইন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করেছে সিমেন্স এনার্জি।

এক বছরের মধ্যে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে ইইউ। এ লক্ষ্য অর্জনে আগামী সাত মাসের মধ্যে গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে একমত হয়েছে জোটভুক্ত দেশগুলো।

রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি কমানোর ঘোষণা দিলেও চাহিদা মেটাতে ইইউর সামনে বিকল্প কী, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

ইইউর জন্য এ ক্ষেত্রে একটা উপায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মতো দেশগুলো থেকে জ্বালানিবাহী জাহাজে করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা।

তবে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রেও বাধা রয়েছে। জ্বালানিবিশেষজ্ঞ কেট ডোরিয়ানের মতে, ইউরোপে যথেষ্ট পরিমাণ এলএনজি টার্মিনাল নেই। এটা একটা সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে জার্মানির জন্য।

রাশিয়া যেভাবে জবাব দিয়েছে

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, ইউরোপের অবন্ধুত্বসুলভ দেশগুলোকে গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধ করতে হবে। পুতিনের এ পদক্ষেপ রুশ মুদ্রার মান বাড়াতে সহায়তা করেছে।

পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া ও ফিনল্যান্ড রুবলে গ্যাসের দাম দিতে রাজি হয়নি। তাই এই দেশগুলোয় গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় মস্কো।

তবে ইউরোপের কিছু জ্বালানি কোম্পানি গ্যাসের দাম রাশিয়ার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করছে। এই অ্যাকাউন্টগুলো ইউরোকে রুবলে রূপান্তরিত করছে।

ইউরোপে কি জ্বালানি তেলের ঘাটতি দেখা দেবে

চলতি বছরের শেষ নাগাদ সমুদ্রপথে রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধে রাজি হয়েছে ইইউ।

রাশিয়ার তেলের ওপর হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়ার মতো দেশের বড় ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে। তাই সাময়িকভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার তেল আমদানির ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র রুশ তেল আমদানির ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত বছর যুক্তরাজ্যের রুশ তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের কিছু দেশের তেল আমদানি কমতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে লিথুয়ানিয়া ও ফিনল্যান্ড তাদের তেলের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ রাশিয়া থেকে পেয়েছিল।

রাশিয়ার থেকে মুখ ফেরানোর পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর অবশ্য অন্য উৎপাদনকারী দেশ থেকে তেল কিনতে পারবে।

চলতি বছরের শুরুতে জ্বালানি তেল আমদানিকারক দেশগুলোর জোট আইইএ তাদের মজুত থেকে ১২ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ছাড়তে সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও তাঁর দেশের তেলের রিজার্ভের একটা বড় অংশ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

নিষেধাজ্ঞা কি কাজ করবে

গত বছর ইউরোপে ৪৩০ বিলিয়ন ডলারের তেল ও গ্যাস বিক্রি করেছে রাশিয়া। ইইউ বলছে, তাদের নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ৯০ শতাংশ কমবে।

কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে কয়েক মাস সময় লাগবে। তখন অবশ্য রাশিয়া তার তেলে অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে পারবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় কম দামে রাশিয়ার তেল কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে ভারত ও চীন।