তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত জানুয়ারির শেষ ভাগে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বুরসা প্রদেশে একটি যুব সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে তিনি জানান, আগামী ১৪ মে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে।
এরদোয়ান পুনর্নির্বাচনের পরিকল্পনা করছেন।
আসন্ন নির্বাচনকে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের তিন মাস আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে তিনি বড় ধরনের চাপে পড়েছেন। বার্তা সংস্থা এএফপির এক বিশ্লেষণে এ কথা বলা হয়।
গত সোমবার সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে দুই দেশে ২৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। শুধু তুরস্কেই নিহত হয়েছে ২০ হাজার ২১৩ জন মানুষ। এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। এই ভূমিকম্প এরদোয়ানের জন্য বিপদ হয়ে এসেছে।
এরদোয়ান ২০০৩ সাল থেকে তুরস্কের ক্ষমতায় আছেন। তিনি প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে প্রেসিডেন্ট পদে আছেন। ভূমিকম্পের আগে তুরস্কে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, আসন্ন নির্বাচন এরদোয়ানের জন্য সহজ হবে না। নির্বাচনে তাঁকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে।
ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে থেকেই এরদোয়ানকে একের পর এক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। অর্থনৈতিক বিষয়ে তাঁর নীতি দেশটিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে ফেলেছে। গত বছর দেশটিতে ভোগ্যপণ্যের দাম প্রায় ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।
একই সময়ে এরদোয়ানকে দাবানলসহ পরিবেশগত অন্যান্য বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হয়েছে। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নাগরিক অধিকার-স্বাধীনতা সংকুচিত করার জন্য এরদোয়ান সমালোচিত।
নানামুখী চ্যালেঞ্জ আছে—তা এরদোয়ান নিজেও জানেন। সে অনুযায়ী, তিনি কাজ করে আসছিলেন।
সোমবার ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পরই এরদোয়ান রাজধানী আঙ্কারায় একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন। পরবর্তী সময়েও তাঁকে তৎপর থাকতে দেখা গেছে।
গত বুধবার এরদোয়ান ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান। এই স্থানগুলোর মধ্যে কাহরামানমারাস ও হাতায় রয়েছে। ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলোর মধ্যে এগুলো অন্যতম। কাহরামানমারাসে ভূমিকম্প-দুর্গত এক কান্নারত নারীকে তিনি জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন।
হাতায় সফরের সময় এরদোয়ান ভূমিকম্পের পর সরকারি পদক্ষেপে তাঁর সরকারের ঘাটতির কথা স্বীকার করে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই ধরনের দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তুরস্কে আগে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। সেই ভূমিকম্পের পর উদ্ধার-ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে তুমুলভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ট ইসেভিট। সে সময় ভালোভাবে দেশ পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেয় এরদোয়ানের দল। ২০০২ সালের নির্বাচনে তাঁর দল জয়ী হয়। এই অভিজ্ঞতার কথা নিশ্চয়ই এরদোয়ানের স্মরণে আছে।
সোমবার ভূমিকম্পের পর এরদোয়ান সরকার দ্রুত চার স্তরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। দেশটির সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানায়। এই আহ্বানে তুরস্কের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীসহ অনেক দেশ সাড়া দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরদোয়ান যদি বর্তমান সংকট ভালোভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন, তাহলে রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলে তাঁকে ইসেভিটের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেনিওর কো-প্রেসিডেন্ট উলফাঙ্গো পিকোলি বলেন, ভূমিকম্পের পর তুরস্কের বর্তমান সরকার যদি একটি কার্যকর জরুরি সাড়া দিতে সক্ষম হয়, তা হলে তা দেশটিতে এরদোয়ানের নেতৃত্বে জাতীয় সংহতির অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে। এই অনুভূতি এরদোয়ান ও তাঁর দলকে শক্তিশালী করতে পারে।
উলফাঙ্গো পিকোলি আরও বলেন, তবে বড় আকারের এই ভূমিকম্প দেশটির বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফরেন পলিসি সেন্টারের রিসার্চ ফেলো এমরে ক্যালিস্কান বলেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী সাড়া সফল না হলে এরদোয়ান আগামী মে মাসের নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন।
ভূমিকম্পের পর সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে ইতিমধ্যে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। উদ্ধার-ত্রাণ তৎপরতার ব্যর্থতা নিয়ে অনেকেই সরকারের সমালোচনা করছেন।
বিশ্লেষক গনুল তোল বলেন, তিনি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখেছেন। তিনি নিশ্চিত, মানুষের এই ক্ষোভের প্রভাব ভোটে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের তুর্কি প্রোগ্রামের পরিচালক গনুল বলেন, ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পর তুরস্কের সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল।
কিন্তু এবার তা কম। কারণ, ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অনেকের বিরুদ্ধে এরদোয়ান কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বিশ্লেষক গনুল বলেন, ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের দুই দশকের বেশি সময় পর তুরস্ক ভালো অবস্থানে নেই। এরদোয়ান শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকেই দুর্বল করেনি, তিনি তুরস্কের সুশীল সমাজকেও দুর্বল করেছেন।