ইউক্রেনের খেরসন শহরের পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। মস্কো বলছে, এটি ইউক্রেনের ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড’। রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর এই প্রথম খেরসন বিদ্যুৎ ও পানিবিচ্ছিন্ন। তবে নিজেদের এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ সরবরাহ করতে পারেনি তারা।
ইউক্রেনের দক্ষিণের এ শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেরসনে যুদ্ধ ব্যাপক রক্তক্ষয়ী হবে।
বর্তমানে খেরসন শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। অন্যদিকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে তাঁদের প্রতিরক্ষা জোরদার করছেন রুশ সৈন্যরা। খেরসন কেন দুই পক্ষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে বিবিসি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
যুদ্ধের আগে খেরসনের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার। কৃষ্ণসাগর উপকূলের কাছে দিনিপ্রো নদীর তীরে শহরটির অবস্থান।
এটি ক্রিমিয়া উপদ্বীপের খুব কাছে, যেটি ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে দখল করে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে নেয় রাশিয়া। ক্রিমিয়ায় এখন রাশিয়ার অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি আছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক মারিনা মিরন বলেন, খেরসন হলো ক্রিমিয়ার প্রবেশদ্বার। এ যুদ্ধে ইউক্রেনের মূল লক্ষ্য হলো ক্রিমিয়া পুনর্দখল। সুতরাং খেরসনের নিয়ন্ত্রণ তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথকে প্রশস্ত করবে।
খেরসনের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোর্বস ম্যাকেঞ্জি। তিনি গোয়েন্দাবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেসের প্রধান নির্বাহী। তিনি বলেন, দিনিপ্রো নদীর নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই নদী ইউক্রেনের একদম কেন্দ্র বরাবর বয়ে গেছে।
খেরসন শহরটি ইউক্রেনের একমাত্র আঞ্চলিক রাজধানী, যা এখন রাশিয়ার দখলে। মার্চের প্রথম দিকে রাশিয়া খেরসন দখল করে নেয়। সম্প্রতি খেরসন এবং ইউক্রেনের আরও তিনটি অঞ্চলকে রাশিয়া তাদের নিজের অংশ বলে ঘোষণা করেছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক মারিনা মিরন বলেন, ইউক্রেনের সৈন্যরা খেরসন পুনর্দখল করতে পারলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে কিয়েভের পালে হাওয়া লেগেছে বলে এমন বার্তা দেবেন। এটি পশ্চিমাদের কাছে প্রমাণ করবে, ইউক্রেনকে সমর্থন করা এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য অর্থ ব্যয় সার্থক।
তবে রুশ সৈন্যরাও খেরসনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া। সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পাল্টাহামলায় তাঁরা দেশের পূর্বাঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা হারিয়েছেন।
মিরন মনে করেন, রাশিয়ার এখন একটি বিজয় খুবই দরকার। রাশিয়াকে দেখাতে হবে, তারা ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধে সক্ষম।
উত্তর ও দক্ষিণ থেকে খেরসন শহরে রুশ সৈন্যদের সরবরাহ লাইন ছিন্ন করার লক্ষ্যে ইউক্রেনের সৈন্যরা সম্প্রতি দিনিপ্রো নদীর ওপর সেতুগুলোয় বেশ কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছেন।
উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ধীরে ধীরে তাঁরা খেরসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। মিরন বলেন, ইউক্রেনের পরবর্তী প্রধান লক্ষ্য দিনিপ্রো নদীর উজানের শহর বেরিস্লাভ। শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে সেখানে থেকে তারা খেরসনের ওপর সহজে হামলা চালাতে পারবে। আর এটি মাত্র কয়েক সপ্তাহের বিষয়।
তবে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্থলযুদ্ধবিষয়ক গবেষক বেন ব্যারি মনে করেন, ইউক্রেনের সৈন্যরা খুবই ধীরগতিতে খেরসন শহরের দিকে এগোচ্ছেন। তাঁদের এখনো খেরসনের উত্তরে রুশ ফ্রন্টলাইন ভেঙে ঢুকতে হবে। সেখানে কর্দমাক্ত অবস্থার কারণে তাঁদের অগ্রাভিযানের গতি কমে যেত পারে। এমনকি রুশ প্রতিরোধ ভেঙে খেরসন শহরে ঢোকা হতো তাঁদের পক্ষে সম্ভব না–ও হতে পারে।
রাশিয়া বলছে, তারা খেরসন শহর থেকে ৭০ হাজার বেসামরিক লোক সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেয়।
খেরসনে রাশিয়ার বেসামরিক প্রশাসনের উপপ্রধান কিরিল স্ট্রেমুসভ বলেছেন, দিনিপ্রো নদীর পশ্চিম তীরে খেরসনের কিছু জায়গা থেকে রুশ সৈন্যরা পিছু হটতে পারেন। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত আমাদের ইউনিটগুলো, আমাদের সৈন্যরা নদীর পূর্ব তীরে চলে যেতে পারেন।’
তবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সন্দেহ করছে, এ ধরনের কথা আসলে রুশদের একটি কৌশল হতে পারে।
ম্যাকেঞ্জি ইন্টেলিজেন্সের হিসাব মতে, খেরসন শহরের প্রতিরক্ষায় ৫ থেকে ১০ হাজার রুশ সৈন্য মোতায়েন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ ইউনিটও রয়েছে।
গবেষণা সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট অব স্টাডি অব ওয়ার বলছে, রুশ সৈন্যরা খেরসন শহরের ভেতর ছাড়াও শহরের উত্তর-পশ্চিমে তাঁদের অবস্থান শক্ত করছেন। বেন ব্যারি বলেন, নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী খবর রয়েছে, রাশিয়া খেরসন থেকে তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু একই সময়ে তারা সেখানে ছত্রীসেনা ও নৌসেনা মোতায়েন করছে।
ফোর্বস ম্যাকেঞ্জি মনে করেন, খেরসন পুনর্দখলে অভিযান শুরু করলে ইউক্রেনের সৈন্যদের চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। ঘরে ঘরে লড়াই হবে। হতাহত হবে অগণিত মানুষ। যার সম্ভাব্য চিত্র খুবই ভয়ংকর।
তবে বেন ব্যারি মনে করেন, শহরের জন্য একটি কঠিন যুদ্ধ, অনিবার্য নয়।
‘দুই পক্ষেরই বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে’ উল্লেখ করে বেন ব্যারি বলেন, রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনীয়দের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে লড়াই চালিয়ে একপর্যায়ে পিছু হটে যেতে পারেন। ইউক্রেনীয়রা শহরে না ঢুকে শহরটি ঘেরাও করে রুশদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেওয়ার কৌশল নিতে পারেন। আসলে কোন পক্ষ কী কৌশল নেওয়ার কথা ভাবছে, তা ধারণা করা এখন প্রায় অসম্ভব।