রাশিয়ার বিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যুর জন্য সরাসরি পুতিনকে দায়ী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমারা নেতারা
রাশিয়ায় কারাবন্দী বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যুর ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দায়ী করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। অবিলম্বে এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর রুশ দূতাবাসের কূটনীতিকদের তলব করেছে যুক্তরাজ্য।
২০২১ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন নাভালনি। গত বছরের শেষ দিকে উত্তর সাইবেরিয়ার ইয়ামালো-নেনেটস অঞ্চলের কারা কলোনিতে নেওয়া হয় তাঁকে। শুক্রবার সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
নাভালনির মৃত্যুর খবর শোনার পরপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র তদন্ত দাবি করেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে এয়ারফোর্স ওয়ানে চেপে ভ্রমণ করছিলেন ওই মুখপাত্র।
এরপর এক বিবৃতিতে নাভালনির মৃত্যুর জন্য সরাসরি পুতিনকে দায়ী করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ ঘটনা নিয়ে রুশ কর্মকর্তারা নিজেদের মতো করে গল্প সাজাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাইডেন বলেন, ‘আপনারা কোনো ভুল করবেন না; নাভালনির মৃত্যুর জন্য পুতিনই দায়ী।’
এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে নাভালনির মৃত্যুর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যখন কেউ কোনো রাষ্ট্রে কারাবন্দী অবস্থায় মারা যান, তখন সেটির ঝুঁকি কিংবা দায়ভার রাষ্ট্রকে নিতে হয়।
এদিকে নাভালনির মৃত্যুর ঘটনায় রুশ সরকারকে দায়ী করেছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ ঘটনায় যুক্তরাজ্যে রুশ দূতাবাসের কূটনীতিকদের তলব করা হয়েছে। রুশ কর্তৃপক্ষের পূর্ণাঙ্গ দায়ভারের বিষয়টি তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হবে।
এ ছাড়া নাভালনির মৃত্যুর ঘটনায় রাশিয়ার ‘বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে জার্মানিতে থাকা ক্যামেরন এ মন্তব্য করেন।
নাভালনির মৃত্যুর খবরে মর্মাহত হয়েছেন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, নাভালনি ছিলেন নিজের বিশ্বাসের নির্ভীক প্রবক্তা। যেই স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা তিনি করেছেন, অবিচল থেকে তাঁর হাতেই তিনি মারা গেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, সদ্য প্রয়াত রাশিয়ার কারাবন্দী বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে শেষবারের মতো টেলিভিশনের পর্দায় হাসিমুখে দেখে গেছে। নিজের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া এবং বিচারকের বেতন নিয়ে মজা করছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার শেষবারের মতো টিভির পর্দায় দেখা যায় নাভালনিকে। সেদিন তিনি কারাকক্ষ থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে আদালতে সাক্ষ্য দেন। পরনে ছিল কয়েদির পোশাক। তাঁকে তখন সুস্থ ও উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। ভিডিওতে আদালতের কর্মকর্তাদের দেখেও মনে হয়েছে, তাঁরা যুক্তিতর্ক উপভোগ করছেন।
আল–জাজিরা জানায়, শুধু নাভালনিই নন, পুতিনের আরও অনেক সমালোচককে একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। আলেক্সান্দার লিৎভিনেঙ্কো ছিলেন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির একজন সদস্য এবং পুতিনের সমালোচক। ২০০৬ সালে চা পান করার পর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তাঁর চায়ে মেশানো ছিল তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ পোলোনিয়াম-২১০।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা পুতিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন লিৎভিনেঙ্কো। এ ছাড়া মস্কোয় অ্যাপার্টমেন্টে বোমা হামলাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে চেচেন যুদ্ধ শুরু করা হয়। পুতিনই ওই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন লিৎভিনেঙ্কো।
যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন লিৎভিনেঙ্কো। লন্ডনে দুই রুশ গোয়েন্দার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চা পান করেছিলেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, পুতিন এই হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন।
রাশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস নেমসভকে ২০১৫ সালে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্রেমলিনের কাছে মস্কোয় একটি সেতু পার হয়ে হেঁটে বাড়ি যাওয়ার পথে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করায় পুতিনের সমালোচনা করে আসছিলেন ৫৫ বছর বয়সী নেমসভ। পুতিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভগুলোতে তিনি নিয়মিতই অংশ নিতেন।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় পাঁচ চেচেনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে এই খুনের হোতাকে শনাক্ত করা যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্রেমলিন এবং পুতিনের মিত্র চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের প্রতি আঙুল তোলেন নেমসভের মিত্ররা।
ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন ক্রেমলিনের সমালোচক ছিলেন না। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কয়েক মাস মিত্র পুতিনের সঙ্গে তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধে তাঁর যোদ্ধাদের ভূমিকার কল্যাণে রাশিয়ায় প্রিগোশিনের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন তিনি। পরে ২০২৩ সালের আগস্টে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ভাগনারপ্রধান।
৬২ বছর বয়সী প্রিগোশিন ওই বছরের জুনে তিনি নিজের যোদ্ধাদের রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর রোস্তভ-অন-দনের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। তখন এক ভাষণে পুতিন বলেছিলেন, এই ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। তবে ভাগনারপ্রধানকে গুপ্তহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন।
এ ছাড়া পুতিনের সমালোচনার জন্য সুপরিচিত অনেকেই নির্বাসনে কিংবা কারাগারে রয়েছেন। পুতিনের সমালোচক ধনকুবের মিখাইল খোদোরকোভস্কি এক দশক কারাভোগের পর ২০১৩ সালে দেশ ছাড়েন।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করায় বিরোধী রাজনীতিক ভ্লাদিমির কারা-মুরজাকে গত বছরের এপ্রিলে ২৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়। ইউরোপে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন বিখ্যাত লেখক বরিস আকুনিন।