অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে মস্কোর রাজপথে নেমে আসে কয়েক শ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান
অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে মস্কোর রাজপথে নেমে আসে কয়েক শ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান

যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

মিখাইল গর্বাচেভ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে অখণ্ড অবস্থায় ধরে রাখতে সংগ্রাম করছিলেন, তখনই কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থী অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। এর কয়েক মাসের মধ্যেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন পতনের দিকে এগোচ্ছিল। এরপরও যতদূর সম্ভব তা ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ। কিন্তু এর মধ্যেই এল বড় ধাক্কা। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে ১৯৯১ সালের ১৯ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থান করে বসে কমিউনিস্ট পার্টিরই একটি অংশ।

শেষ পর্যন্ত জনতার প্রতিরোধের মুখে মাত্র তিন দিনের মাথায় ব্যর্থ হয় অভ্যুত্থানের চেষ্টা। কিন্তু এই ধাক্কাতেই যা হওয়ার হয়ে যায়। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে যান গর্বাচেভ। কয়েক মাসের মধ্যেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে প্রায় ৭০ বছর ধরে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখা সোভিয়েত ইউনিয়ন।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন গর্বাচেভ। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারে হাত দেন তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো পর্যালোচনা করা। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টার মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। এ পতন ত্বরান্বিত করেছিল ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থান।

যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে গর্বাচেভ

রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে স্তাভরোপোলে ১৯৩১ সালের ২ মার্চ মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভের জন্ম। তাঁর মা-বাবা দুজনেই যৌথ খামারে কাজ করতেন। কৈশোরে গর্বাচেভ ফসল কাটার কাজে অংশ নিতেন।

১৯৫৫ সালে মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন গর্বাচেভ। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বিয়ের পর স্তাভরোপোলে স্ত্রী রাইসার সঙ্গে ফিরে আসেন গর্বাচেভ। আঞ্চলিক পর্যায়ে দল গঠনের কাজ করতে শুরু করেন তিনি। দলে তাঁর দ্রুত উত্থানও হতে থাকে।

দলের শীর্ষ পর্যায়ে প্রবীণদের সংখ্যা বেশি থাকায় যাঁদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল, তাঁদের একজন ছিলেন গর্বাচেভ। ১৯৬১ সালের দিকে ইয়াং কমিউনিস্ট লিগের আঞ্চলিক সম্পাদক হন গর্বাচেভ। তিনি পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিও হন।

শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ

কৃষিতে অভিজ্ঞতার সুবাদে ১৯৭৮ সালে সেন্ট্রাল কমিটিজ সেক্রেটারিয়েট ফর অ্যাগ্রিকালচারের সদস্য হিসেবে মস্কোয় যান গর্বাচেভ। দুই বছর পর তিনি পলিটব্যুরোর পূর্ণ সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৪ সালে ইউরি আন্দ্রোপভের মৃত্যুর পর গর্বাচেভ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বদলে কনস্তান্তিন চেরনেনকো দলের সাধারণ সম্পাদক হন।

এক বছরের মধ্যে চেরনেনকোও মারা যান। এরপর তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে পলিটব্যুরোর সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হন গর্বাচেভ। ১৯৮৫ সালের মার্চে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত গর্বাচেভ কার্যকরভাবে সোভিয়েত রাজনীতির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন।

গর্বাচেভ অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সংস্কারের (পেরেস্ত্রোইকা) মাধ্যমে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বলেন, পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র দরকার। গণতন্ত্রের চর্চা হলেই সমাজতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। তাঁর পেরেস্ত্রোইকার প্রথম স্লোগান ছিল ‘আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র’।

পেরেস্ত্রোইকার আগে গর্বাচেভ শুরু করেন ‘গ্লাসনস্ত’ (কথা বলার স্বাধীনতা)। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ গ্লাসনস্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। তাঁরা মুক্তির নিশ্বাস ফেললেন। কিন্তু সবাই যখন নির্ভয়ে কথা বলার ও লেখার সুযোগ পেল, তখন যে বিষয়টা প্রকট হয়ে উঠল, তা হলো অতীতের সমালোচনা। অতীতের অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ভুল ও ব্যর্থতাগুলো। কট্টর গণতন্ত্রপন্থীরা বলতে শুরু করলেন, ভুল বা ব্যর্থতা নয়, সেগুলো ছিল ‘অপরাধ’।

অভ্যুত্থানের সূচনা

গর্বাচেভ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে অখণ্ড অবস্থায় ধরে রাখতে সংগ্রাম করছিলেন, তখনই কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থী অংশ অভ্যুত্থান শুরু করে। ওই সময় গর্বাচেভ কৃষ্ণসাগরের উপকূলের অবকাশযাপন কেন্দ্র ফোরোসে অবস্থান করছিলেন।

১৯৯১ সালের ১৮ আগস্ট কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা গর্বাচেভের অবকাশকালীন বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। তাঁরা দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে গর্বাচেভের প্রতি আহ্বান জানান।

অভ্যুত্থানকারীরা সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সই হতে যাওয়ায় ইউনিয়ন চুক্তি ঠেকাতে চাইছিলেন। দুই দিন পর ওই চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। এই চুক্তিকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছিলেন গর্বাচেভ।

সামরিক কর্মকর্তাদের জরুরি অবস্থা জারির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন গর্বাচেভ। এ সময় অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীরা সোভিয়েত নেতার যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দেন। তাঁকে ওই বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

পরদিন ১৯ আগস্ট ঘুম থেকে উঠে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাসিন্দারা। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়, স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় দেশ পরিচালনার মতো অবস্থায় নেই গর্বাচেভ। ক্রমবর্ধমান ‘নৈরাজ্য ও অরাজক অবস্থা’ থেকে দেশকে রক্ষায় ‘স্টেট কমিটি অন দ্য স্টেট অব ইমার্জেন্সি’ গঠন করা হয়েছে। একই সময়ে শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে কয়েক শ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান মস্কোর রাজপথে এগিয়ে যেতে থাকে।

কিন্তু অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করে তাৎক্ষণিক হাজার হাজার মানুষ রুশ ফেডারেশনের সরকারি ভবনের চার পাশে জড়ো হতে থাকেন। রুশ ফেডারেশন ছিল সোভিয়েতভুক্ত ১৫টি দেশের একটি।

রুশ ফেডারেশনের নেতা বরিস ইয়েলৎসিন এ সময় প্রতিরোধের মুখ হয়ে ওঠেন। লেনিনের অনুকরণে ট্যাংকে উঠে গর্বাচেভের মুক্তি দাবির পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানান। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইয়েলৎসিনের অনুগত বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করায় ২১ আগস্টই অভ্যুত্থানের চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, কারফিউ উপেক্ষা করে ওই সময় প্রায় দুই লাখ মানুষ মস্কোর রাজপথে নেমে এসেছিলেন।

ইয়েলৎসিন সেনা অভ্যুত্থানের অবসান ঘটান। বিক্ষোভকারীদের আটক করেন। আর মুক্তির বিনিময়ে গর্বাচেভের প্রায় সব রাজনৈতিক ক্ষমতা হরণ করেন। গর্বাচেভ যখন মস্কোয় ফিরে আসেন, তখন তিনি একজন ক্ষীণ ও দুর্বল ব্যক্তি।

সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ও রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৪ আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টির নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেন গর্বাচেভ। কমিউনিস্ট পার্টির সব সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দেন। সব রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে দলটিকে নিষিদ্ধ এবং দলটি যাতে নিজ থেকেই বিলুপ্ত করে, তার পরামর্শ দেন। ইউক্রেনের পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাজাখস্তান ও রাশিয়া ছাড়া অন্যরাও একই পথ অনুসরণ করে।

৬ সেপ্টেম্বর লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত সর্বোচ্চ আইনসভা। কংগ্রেস ১৯২২ সালের ইউনিয়ন চুক্তি বাতিল করে। স্বেচ্ছায় ‘সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ইউনিয়ন’ গঠনে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

এরপর ৮ ডিসেম্বর রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ ‘কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ কিংবা গর্বাচেভের ভূমিকা থাকবে না। প্রথমে নতুন এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন গর্বাচেভ এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ধীরে ধীরে এই অনিবার্য বাস্তবতাকে মেনে নেন।

শেষ পর্যন্ত ২৫ ডিসেম্বর গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও বিলুপ্তি ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে জনজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন গর্বাচেভ। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ৯১ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

তথ্য সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি ও তাস