বেলারুশে রুশ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিণতি কী হতে পারে

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সামরিক যান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন, বেলারুশে তিনি ‘কৌশলগত’ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে চান। তাঁর এই ঘোষণা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে রুশ ভূখণ্ডে হামলা ঠেকাতে ‘সম্ভব সব উপায়’ কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এ কথা বলে দৃশ্যত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিই ইঙ্গিত করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট।

বেলারুশ গতকাল মঙ্গলবার বলেছে, তারা রুশ পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেলারুশের রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক গতিপথ পাল্টে দিতে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এক বিবৃতিতে বেলারুশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বিগত আড়াই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের ন্যাটো মিত্রদের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোর নজিরবিহীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অপপ্রচারে চাপের মুখে পড়ে বেলারুশ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ ও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ জন্য বেলারুশ নিজেদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সামর্থ্য জোরদারে বাধ্য হয়েছে।

মিনস্ক বলছে, রাশিয়ার পারমাণবিক পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি লঙ্ঘন করবে না। কারণ, বেলারুশ নিজে এই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে না।

পুতিন যা বলছেন

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো দীর্ঘদিন ধরে তাঁর দেশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে মস্কোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা চালানোর সময় বেলারুশের ভূখণ্ড ব্যবহার করেছিল রাশিয়া।

রাশিয়া ইতিমধ্যে বেলারুশের যুদ্ধবিমানগুলো আধুনিকায়ন করে পারমাণবিক অস্ত্র বহনের উপযোগী করে তুলেছে। বিষয়টি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন দেশটির কর্তৃত্ববাদী নেতা লুকাশেঙ্কো।

গত রোববার সম্প্রচারিত বক্তব্যে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ইউক্রেনকে ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়াম শেল দেবে যুক্তরাজ্য সরকার, সিদ্ধান্ত ঘোষণার জবাবে তাৎক্ষণিক বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট আরও বলেছেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও তুরস্কে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র যে কাজটি করে আসছে, বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়াও একই কাজটিই করবে।

কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র কী

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসেনা ও তাদের অস্ত্র ধ্বংসে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এসব অস্ত্র তুলনামূলকভাবে স্বল্পপাল্লার এবং দূরপাল্লার স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেপণাস্ত্রে বসানো পারমাণবিক ওয়ারহেডের তুলনায় বিস্ফোরক ক্ষমতাও অনেক কম। দূরপাল্লার স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেপণাস্ত্রে বসানো পারমাণবিক ওয়ারহেড পুরো শহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।

মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে করা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির ফলে স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্র রাখার ক্ষেত্রে সীমা ঠিক করে দেওয়া আছে। কিন্তু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে কোনো চুক্তির মাধ্যমে এ ধরনের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি।

এর ফলে রাশিয়া এসব অস্ত্রের সংখ্যা কখনো প্রকাশ করেনি এবং এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, রাশিয়ার কাছে দুই হাজার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে যুদ্ধবিমানে পরিবহন করার মতো বোমা, স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে বসানোর মতো ওয়ারহেড এবং কামানের গোলা রয়েছে।

স্ট্র্যাটেজিক পারমাণবিক অস্ত্র সাধারণত ভূমি কিংবা সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপিত আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে বসিয়ে হামলায় ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার কিছু সুরক্ষিত স্থাপনায় মজুত আছে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সেনাদলের কাছে এসব অস্ত্র সরবরাহে কিছুটা সময় লাগে।

সরবরাহের অংশ হিসেবে কিছু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে রাখতে ক্রেমলিনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন কয়েকজন রুশ যুদ্ধবাজ। পশ্চিমাদের সতর্ক করার অংশ হিসেবে তাঁরা এ পদক্ষেপ নিতে বলছেন।

রাশিয়া ঠিক কী করতে যাচ্ছে

পুতিন বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র বহনের উপযোগী করে তুলতে ইতিমধ্যে বেলারুশের ১০টি উড়োজাহাজের আধুনিকায়নে সহযোগিতা করেছে রাশিয়া। আগামী ৩ এপ্রিল থেকে তাদের ক্রুরা প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করবেন। তিনি আরও বলেন, বেলারুশকে ইস্কান্দার স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে রাশিয়া। এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রথাগত কিংবা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।

রুশ প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ১ জুলাই নাগাদ বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের স্থাপনা নির্মাণ শেষ হবে। তবে সেখানে কতগুলো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে কিংবা কখন সেগুলো মোতায়েন করা হবে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।

পুতিন জোর দিয়ে বলেছেন, বেলারুশে মোতায়েন করা যেকোনো পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতেই থাকবে, ঠিক ন্যাটো মিত্রদের ভূখণ্ডে মোতায়েন করা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে করে থাকে।

মস্কো যদি বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে থাকে, তবে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকের পর এটি হবে রাশিয়ার সীমান্তের বাইরে প্রথম এ ধরনের অস্ত্র মোতায়েন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর পারমাণবিক অস্ত্র পায় বেলারুশ, ইউক্রেন ও কাজাখস্তান। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এসব অস্ত্র রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিতে সম্মত হয় এসব দেশ।

সম্ভাব্য পরিণতি কী

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও তীব্র করতে মস্কোর প্রস্তুতির কথা জানান দিতেই সর্বশেষ বক্তব্যেও পুতিন পারমাণবিক হুমকির বিষয়টি এনেছেন। ইউক্রেনের সঙ্গে বেলারুশের ১ হাজার ৮৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

বেলারুশে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হলে সেগুলো দিয়ে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুতে আরও সহজেই হামলা চালাতে পারবে রুশ উড়োজাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্র। একই সঙ্গে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের কয়েকটি ন্যাটো সদস্যদেশে হামলার ক্ষেত্রেও এতে রাশিয়ার সক্ষমতা বাড়বে।

এমন সময় রাশিয়া এই পদক্ষেপ নিল, যখন পাল্টা হামলা চালিয়ে রাশিয়ার দখলে থাকা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ‘ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের প্রতিটি দিন পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞকে ঘনিয়ে আনছে।’

ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক ওলেহ ঝদানভ বলেন, পুতিনের লক্ষ্য কিয়েভকে আরও অস্ত্র সরবরাহ থেকে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের নিরুৎসাহিত করা। পুতিন যুদ্ধকে প্রভাবিত করতে এবং পারমাণবিক উত্তেজনার হুমকির মাধ্যমে কিয়েভের পশ্চিমা অংশীদারদের অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ কমাতে বাধ্য করতে পারমাণবিক ব্ল্যাকমেলকে কাজে লাগাচ্ছেন।

এই সামরিক বিশ্লেষক বলেন, বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন কেবল ইউক্রেন নয়, ইউরোপের ওপরেও প্রভাব ফেলবে। এটি ক্রমাগত হুমকি তৈরি করবে, উত্তেজনা বাড়াবে এবং ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা অংশীদারদের স্নায়ুচাপ বাড়াবে।

ইউক্রেন ও পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া

পুতিনের পদক্ষেপে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকার আহ্বান জানায় ইউক্রেন। জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে গত সোমবার বিকেল নাগাদ এ বিষয়ে কোনো বৈঠক আহ্বান করা হয়নি।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পর্ষদের মুখপাত্র জন কিরবি সোমবার বলেন, বেলারুশসংক্রান্ত ঘোষণার পর কোনো ধরনের কৌশলগত অস্ত্র বা এ ধরনের কোনো কিছু স্থানান্তরের মতো কিছু দেখেননি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।

ন্যাটোর মুখপাত্র ওনা লুঙ্গেসকু বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার বক্তব্য বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত মনোভাবে কোনো পরিবর্তন দেখেনি জোটের সদস্যরা।