‘বাখমুতের ভূত’ বা ‘ঘোস্টস অব বাখমুত’। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বাখমুত শহর–সংশ্লিষ্ট কিছু। শহরটি এখন রুশ সেনাদের দখলে রয়েছে। এটিকে দখল মুক্ত করতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের বাহিনী। তাদেরই একটি দলের নাম বাখমুতের ভূত। দলটির কাজ স্নাইপার বন্দুক দিয়ে দূর থেকে নিঃশব্দে গুলি চালিয়ে শত্রুদের ধরাশায়ী করা।
বাখমুতের ভূত দলটির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল বিবিসির সাংবাদিকদের। দলের কমান্ডার তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন শহরের উপকণ্ঠে নিজেদের ঘাঁটিতে। ওই কমান্ডার বলেন, ‘আমাকে “ভূত” নামে ডাকা হয়। আমরা যখন বাখমুতে লড়াইয়ে নেমে রুশ যোদ্ধাদের ভয় ধরাতে শুরু করলাম, তখন আমাদের বাখমুতের ভূত নাম দেওয়া হয়েছিল।’
বাখমুতের ভূত দলটিতে প্রায় ২০ জন সেনা রয়েছেন। ছয় মাস ধরে তাঁরা এ অঞ্চলে যুদ্ধ করছেন। শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ হর্তাকর্তাদের ধরাশায়ী করতে প্রায়ই অভিযানে নামেন তাঁরা। দলটি এখন পর্যন্ত কতজন রুশ সেনাকে হত্যা করেছে—এমন প্রশ্ন করা হলে দলের কমান্ডারের জবাব, ‘৫২৪ জন যে মারা গেছেন, সেটা নিশ্চিত। এর মধ্যে ৭৪ জনকে আমিই মেরেছি।’
বাখমুতের ভূত রাতের আঁধারে অভিযান চালায়। বিবিসির সাংবাদিকেরা যেদিন দেখা করেছিলেন, সেদিন রাতেও তাদের একটি অভিযান ছিল। সে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন কুজিয়া নামের এক সেনা। একসময় তিনি কারখানায় কাজ করতেন। বন্দুক মোটেও পছন্দ করতেন না। রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর সেই কুজিয়াই বাধ্য হন বন্দুক হাতে তুলে নিতে।
তবে বাখমুতে তিনি কোনো মানুষ হত্যা করছেন না বলে মনে করেন কুজিয়া। তাঁর ভাষ্য, তিনি শুধু শত্রুদের নিঃশেষ করছেন। সেদিন রাতে অভিযানে যাওয়ার আগে নিজের স্নাইপার রাইফেলটি শেষবারের মতো খুঁটিয়ে দেখছিলেন কুজিয়া। এ সময় বলেন, ‘প্রতিটি অভিযানই ভয়ংকর। আমরা একটা ভুল করলে শত্রুরা উল্টো আমাদের ওপর আঘাত হানতে পারে।’
অভিযানে কুজিয়ার সঙ্গে থাকবেন তারাস নামের আরেক সেনা। তাঁর কাজ লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করাসহ নানা তথ্য দিয়ে কুজিয়াকে সাহায্য করা। কুসচ নামের একজন গাড়িতে করে তাঁদের যুদ্ধের সম্মুখসারির কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছাতে কুজিয়া ও তারাসকে আরও এক মাইলের বেশি হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। এ সময়টাতে দলের কমান্ডার ঘাঁটিতেই থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন ব্রিট নামের একজন। তিনি দলে নতুন যোগ দিয়েছেন।
ব্রিট যুক্তরাজ্য থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখনো শত্রুপক্ষের কাউকে হত্যা করে শিকারের খাতা খোলার সুযোগ হয়নি তাঁর। দলের কমান্ডার বলেন, তিনি সবাইকে খুবই যাচাই–বাছাই করে দলে নেন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় তাঁদের ‘মানবতা ও দেশপ্রেমকে’। কে কতটা সামরিকভাবে অভিজ্ঞ বা দক্ষ, তা এখানে মুখ্য নয়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে দলের সদস্যরা তাঁদের গাড়িতে উঠলেন। সঙ্গে গেলেন বিবিসির সাংবাদিকেরা। সম্মুখসারির কাছাকাছি যেখানে কুজিয়া ও তারাসকে নামিয়ে দেওয়া হবে, সে পর্যন্ত যাবেন তাঁরা। গাড়িচালক কুসচ বলেন, এই পথ রাশিয়ার কামানের নিশানায় রয়েছে। গাড়ি চলা শুরু করলে তিনি একটি গান ছাড়লেন। গানটি নাকি তাঁদের মনোবল বাড়ানোর কাজে লাগে। গান চালানোর আরেকটি সুবিধা রয়েছে। এর ফলে গোলার বিস্ফোরণের শব্দ অনেকটা ঢেকে যায়।
গাড়িটি বেশ জোরে শব্দ করে চলছিল। ফলে আশপাশে গোলা বিস্ফোরিত হলে, তার শব্দ পাওয়া কঠিন ছিল। কুসচ কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় অনেকবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন, আর বলছিলেন, ‘আসছে’। এর পরপরই আশপাশে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। কুসচ আসলে রুশ কামানের গোলাগুলো ছুটে আসার কথা বলছিলেন।
পথে ইউক্রেনীয়দের বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়ে পড়ে ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, সেগুলো কামানের গোলা থেকে বাঁচতে পারেনি। এ ছাড়া পথের পাশে মাইন পুঁতে রাখা জায়গাগুলোও দেখাচ্ছিলেন কুসচ। ২০ মিনিট পর গাড়িটি একটি ধ্বংস হওয়া বাড়ির কাছে থামল। এরপর গাড়ি থেকে নেমে দূরে গাছের সারির দিকে হারিয়ে গেলেন কুজিয়া ও তারাস।
এবার ছিল ঘাঁটিতে ফেরার পালা। পথে বিকট শব্দে একটি গোলার বিস্ফোরণ হলো। গাড়িটি থেকে বাজে শব্দ আসা শুরু করল। কুসচ গাড়ি চালাতে চালাতেই দরজা খুলে দেখলেন, পেছনের একটি চাকা ফেড়ে ঢুকে গেছে গোলার একটি ধারালো অংশ। ঘাঁটিতে ফেরার পর তিনি দেখালেন, চাকার টায়ার ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
রাত ঘনিয়ে এলে কমতে শুরু করল গোলার শব্দ। ঘাঁটির ভেতরে তখন সবার শঙ্কাভরা চেহারা। রেডিওতে অভিযানে যাওয়া দুজনের বার্তা পাওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। কিছুটা ঘুমিয়ে সাত ঘণ্টা পর আবার একই পথে যাওয়ার পালা। তখন গভীর রাত। এরপরও কুসচ হেডলাইট বন্ধ করে গাড়ি চালিয়ে গেলেন। ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনা হলো কুজিয়া ও তারাসকে। কুজিয়া শুধু বলেন, ‘একটা গুলিতে, একটা খতম’।
পরে তাঁরা বিবিসির সাংবাদিকদের সে রাতের অভিযানের ভিডিও দেখালেন। বলেন, তাঁরা একজন রুশ সেনাকে হত্যা করেছেন। তিনি মেশিনগান দিয়ে ইউক্রেন সেনাদের ওপর গুলি করছিলেন। এরপর পরদিন রাত পর্যন্ত বিশ্রাম। কুজিয়া বলেন, ‘ফিরে আসতে পেরে আমি খুশি। আর সবাই যে বেঁচে আছে, তা দেখে ভালো লাগছে।’
গত ছয় মাসে এই বাখমুতের ভূত দলটির অনেকেই আহত হয়েছেন। এমনকি দলের কমান্ডারও। তবে কেউ মারা যাননি। কমান্ডার বলেন, ‘প্রতিটি অভিযান আমাদের শেষ অভিযান হতে পারে। তবে আমরা যেটা করছি, তা হলো ভালো কাজ।’
স্নাইপারদের এই দল আকারে রুশ বাহিনীর তুলনায় অনেক ছোট। তারা হয়তো একাকী জয় পাবে না কিংবা বাখমুতকে মুক্ত করতে পারবে না। তবে নিজেদের ছোট অবদানেরও অনেক বড় গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন দলের সদস্যরা। যেমন কুসচ বলেন, ‘আমাদের অভিযান শত্রুদের ওপর মানসিক প্রভাব ফেলে। কারণ, রাশিয়ার সেনারা দেখতে পারছেন না যে হামলা কোথা থেকে হচ্ছে। গুলির কোনো শব্দও তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন না।’