ট্রাইব্যুনালে শুনানি

যৌন নিপীড়নের জন্য সিরিয়ায় শামীমাকে পাচার করে আইএস

শামীমা বেগম
ছবি: টুইটার

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, জঙ্গি দল ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য ছেড়েছিলেন কিশোরী শামীমা বেগম। এরপর শামীমার যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব বাতিল হয়। এই ইস্যুতে বিচারকাজ করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানিতে শামীমার আইনজীবীরা বলছেন ভিন্ন কথা। খবর বিবিসির।

ট্রাইব্যুনালে শামীমার পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, যৌন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে আইএসের পাচারের শিকার হয়েছিলেন শামীমা। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসির ‘আই অ্যাম নট এ মনস্টার পডকাস্ট’–এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামীমাও বলেছেন এমন কথা।

শুনানিতে দুই পক্ষ যা বলছে

২০১৫ সালে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন শামীমা। জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় ২০১৯ সালে তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।

শামীমার অভিবাসন নিয়ে পাঁচ দিন ধরে শুনানি চলেছে। সেই শুনানিতে শামীমার যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিলস কমিশনে (এসআইএসি) এই মামলার শুনানি হয়েছে। এই কমিশনের মর্যাদা হাইকোর্টের সমান। প্রয়োজনে গোপনে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে এই কমিশনে শুনানি হয়।
শুনানিতে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ২৩ বছরের শামীমা সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এখনো হুমকি।

শামীমার আইনজীবীরা বলেছেন, শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেড়ে নেওয়ার ঘটনা অনৈতিক। শামীমা পাচারের শিকার হয়েছিলেন কি না, তা বিবেচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির মন্ত্রণালয়।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সশস্ত্র রক্ষী নিয়ন্ত্রিত একটি শিবিরে রাখা হয়েছিল শামীমাকে। প্রায় আট বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। পূর্ব লন্ডনের অন্য দুই স্কুলছাত্রী খাদিজা সুলতানা (১৬) ও আমিরা আবাসের (১৫) সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন শামীমা।

শামীমার পারিবারিক আইনজীবী বলেছিলেন, সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলায় তিনি নিহত হয়েছেন। শামীমার সঙ্গে চলে যাওয়া আবাস কোথায়, তা জানা যায়নি। তবে ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, আবাস এখনো বেঁচে আছেন।

বিবিসির পডকাস্টে শামীমা যা বলেছিলেন

গত আগস্ট মাসে বিবিসি নিউজের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, শামীমাকে সিরিয়ায় পাচার করা হয়েছিল।

একটি গোয়েন্দা সংস্থা সে সময় কানাডার হয়ে কাজ করছিল। ওই সংস্থাই শামীমাকে পাচারের জন্য দায়ী। কানাডীয় সরকার তখন বলেছে, তারা এই অভিযোগের তদন্ত চালাবে।
সিরিয়ায় শামীমার সঙ্গে নেদারল্যান্ডের নিযুক্ত আইএসের এক সদস্যের সঙ্গে বিয়ে হয়। আইএসের অধীনে তাঁরা তিন বছরের বেশি সময় বসবাস করেন।

২০১৯ সালে ব্রিটিশ টাইমস পত্রিকার এক খবরে জানা যায়, শামীমা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি সিরিয়ার একটি শরণার্থীশিবিরে আছেন। পরে শামীমার সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শামীমা বলেন, এর আগেও তিনি দুই সন্তানকে হারিয়েছেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসির আই অ্যাম নট আ মনস্টার পডকাস্টে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, আইএস দলে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত। জীবনে যে কয় দিন বাঁচবেন, এই অনুতাপ তাঁর থাকবে। বাকি জীবন যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবেন তিনি।
শামীমা ওই পডকাস্টে আরও বলেন, ম্যানচেস্টার অ্যারেনা এলাকায় ২০১৭ সালে বোমা হামলায় ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল। এটি ছিল আইএসের ঘাঁটিতে সামরিক হামলার প্রতিশোধ।

প্রায় আট বছর আগে পূর্ব লন্ডনে স্কুলের দুই বন্ধুর সঙ্গে নিখোঁজ হন শামীমা বেগম। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, তাঁরা সিরিয়ায় আইএস দলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
বিবিসির ওই পডকাস্টে বলা হয়, প্রায় এক বছর আগে সিরিয়ার উত্তর–পূর্বে একটি শিবির থেকে শামীমা সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে শামীমা এবং দুই নারীকে সন্তানসহ আইএসরা রেখেছিল।

বিবিসির ওই পডকাস্টে একান্ত সাক্ষাৎকারে শামীমা বলেন, যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগে তিনি পাচারের শিকার হয়েছিলেন। আইএস এ বিষয়ে তাঁকে বিস্তারিত যেসব নির্দেশনা দিয়েছিল, তা–ও তিনি বলেন।
শামীমা আরও বলেন, আইএসের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির সহায়তা ছাড়া তিনি কখনোই সিরিয়ায় যেতে পারতেন না। আইএসের মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ওই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আল রাশেদ বলে জানান শামীমা।

ট্রাইব্যুনালে এমআইফাইভের সদস্য যা বলেন

ট্রাইব্যুনালে আজ সোমবার শামীমা বেগমের আইনজীবী বলেছেন, শামীমা পাচারের শিকার হয়েছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকির অজুহাতে তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
তবে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনজীবীরা বলেন, শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। তাঁরা বলেন, শামীমা নিরাপত্তার জন্য আইএস এলাকা থেকে পালিয়েছিলেন। কিন্তু আইএসের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট নন, তা বলা যাবে না।

ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনজীবীরা আরও বলেন, শামীমাকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত কয়েক ধাপে পর্যালোচনা করে নেওয়া হয়েছে। শামীমা জঙ্গি দলে যোগ দেওয়ার জন্য কোনো অনুতাপ করেননি। তিনি যখন সিরিয়ায় যান, তখন আইএসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সব জানতেন শামীমা।

যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইফাইভের পরিচালিত এক প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা আইএস–অধ্যুষিত এলাকায় ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা সবাই আইএসের সহিংস কার্যক্রম সম্পর্কে জানতেন।

শুনানি চলাকালে শামীমার আইনজীবীরা এমআইফাইভের এক কর্মকর্তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির করেন। ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, শামীমা মানবপাচারের শিকার হতে পারেন। তবে তিনি  হুমকিও হতে পারেন।

শুনানিতে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলে, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে শামীমা পুলিশকে বলেছিলেন, তাঁর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি আইএসকে সমর্থন করতেন। এই শুনানি পাঁচ দিন ধরে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।