এক বছর আগে আজকের দিনে (২৪ ফেব্রুয়ারি) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে ক্রিমিয়ার মতো আরেকটি অংশকে দখলে নেওয়ার জন্য যে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু করেছিলেন, তা এখন এমন এক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে, যা কীভাবে শেষ হবে, তা কেউই বলতে পারছে না। তবে শিগগিরই যে ইউক্রেনে রক্তপাত এবং বাকি বিশ্বের ভোগান্তির ইতি ঘটছে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এ ভোগান্তি শুধু অর্থনৈতিক নয়; তার সঙ্গে আছে ভূরাজনীতির জটিল গতিধারার তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
ইউরোপে এখন একটি বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই দানা বাঁধছে। এই পটভূমিতেই গত বুধবার ওয়ারশতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য পূর্ব ইউরোপের নয়টি দেশ–বুখারেস্ট নাইনের নেতাদের কাছে নিজের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন যে তাঁরা কেউ আক্রান্ত হলে পুরো ন্যাটোই আক্রান্ত হয়েছে গণ্য করে তার জবাব দেওয়া হবে। এর আগের দিন পুতিন ২০১০ সালে স্বাক্ষরিত নতুন কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে রাশিয়ার অংশগ্রহণ স্থগিতের ঘোষণা দেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের যাচাই করা হিসাবে এই বর্ষব্যাপী যুদ্ধে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬ জন, আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৮৭ জন। যাচাই হয়নি, এমন দাবি এর কয়েক গুণ। আর সামরিক হতাহতের সংখ্যা আদৌ কোনো দিন জানা যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।
রাশিয়া ও ইউক্রেন কোনো পক্ষই সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করেনি। তবে পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রুশ বাহিনীর প্রাণহানির সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি বলে গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে ছাপা হয়েছে। রাশিয়ার বিপুল ক্ষয়ক্ষতির দাবি বিশ্বাসযোগ্যতা পায় গত বছর অভিযানের শুরুর দিকে। সে সময় রুশ বাহিনীর প্রায় ৩৫ মাইল দীর্ঘ ট্যাংকবহরের হঠাৎ করে পিছু হটা এবং বিপুলসংখ্যক ট্যাংক পরিত্যক্ত অথবা ধ্বংস হওয়ার ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। এরপর রাশিয়ায় তরুণদের সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের নির্দেশ থেকেও রুশ বাহিনীর বিপুল ক্ষতি কাটানোর চেষ্টার সাক্ষ্য মেলে।
রুশ সেনাবাহিনী ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বিপুল সামরিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধ জয় করতে চাইলেও সে কৌশল সফল হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন নতুন করে রণকৌশল সাজিয়েছেন, যুদ্ধের সেনাপতি বদল করেছেন। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তিনি যে পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত নন, তা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সুবিধা হচ্ছে রাশিয়ায় তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাঁকে কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না, যেমনটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হয়ে থাকে। তাঁর যুদ্ধনীতি ও সামরিক ব্যর্থতার বিরুদ্ধে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ যতটুকু তৈরি হয়েছে, তার কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক রূপ নেই। ফলে যুদ্ধ শেষ করার জন্য তাঁর ওপর সময়ের কোনো চাপ নেই।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমের দেশগুলো যেসব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, রুশ অর্থনীতিতে তার প্রতিকূল প্রভাব যতটা ধারণা করা হয়েছিল, ততটা পড়েনি। পশ্চিমা জোটের বাইরে চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিকাশমান বড় অর্থনীতিগুলো নিষেধাজ্ঞায় অংশ তো নেয়ইনি, উপরন্তু রাশিয়ার জ্বালানি কম দামে কেনার সুবিধা নিয়েছে। ফলে রুশ অর্থনীতির সংকোচন ঘটলেও, তা সামান্যই। সুতরাং প্রেসিডেন্ট পুতিন যুদ্ধের জন্য সম্পদ বরাদ্দে এখনো বড় কোনো সমস্যায় পড়েননি।
বিপরীতে ইউক্রেনের সামর্থ্য ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা খুবই স্পষ্ট। সাগরপথে রুশ অবরোধের কারণে ইউক্রেনের কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে না। অর্থনীতি ও অস্ত্রের জন্য দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। অস্ত্রের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে প্রায়ই বিভিন্ন রাজধানীতে ধরনা দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো সমরাস্ত্র সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে সহায়তা দিলেও তা মূলত দেশটির আত্মরক্ষার জন্য, আক্রমণাত্মক নয়। ইউক্রেনের যুদ্ধ পুরোটাই নিজেদের সীমানা রক্ষা করা, রাশিয়ার ভেতরে পাল্টা আক্রমণ নয়। এ এক অদ্ভুত অসম যুদ্ধ, যেখানে আগ্রাসী রাশিয়ার আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে পুরো ইউক্রেন, কিন্তু ইউক্রেনীয়দের একমাত্র করণীয় হচ্ছে নিজেদের ও ভৌগোলিক সীমানা রক্ষা করা।
ইউক্রেন যুদ্ধ, অনেকের মতে, রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো জোট তথা যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ লড়াই। ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই রাশিয়ার মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের শুরু, যার পরিণতিতে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে দেশটি ন্যাটোর প্রভাববলয় বিস্তারের চেষ্টাকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার চলমান আগ্রাসী যুদ্ধের পরিণতিতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠিকই ঘটছে, যদিও তা অন্য আরেক প্রান্তে। নরওয়ে ও সুইডেন সামরিক জোটের প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বর্জন করে এখন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথে।
এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিপরীতে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বেশ সফল হয়েছেন বলেই সাধারণভাবে মনে করা হয়। রুশ জ্বালানি, বিশেষত গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা এই এক বছরে ৪০ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে কমে এসেছে, যাকে যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা কৌশলের সাফল্য বলে গণ্য করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভাজন।
ইউক্রেনকে শত শত কোটি ডলারের সাহায্য দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্রমেই সোচ্চার হচ্ছে। কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বাড়তি সমস্যার মুখে পড়তে হবে।
বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষও কত দিন ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সে কারণেই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আছেন সময়ের চাপে। যুক্তরাষ্ট্র যে সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িত হবে না, সে কথা তিনি আগেই বলেছেন। সে কারণেই তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা ইউক্রেনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লড়ব না।’ কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে তার আকস্মিক ও নাটকীয় বিস্তৃতির আশঙ্কা একেবারেই নাকচ করা যায় না।
চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের চেষ্টাও ক্রমে জোরদার হচ্ছে। চীন রুশ অভিযানকে সমর্থন করেনি ঠিকই, কিন্তু নিন্দাও করেনি। রুশ আগ্রাসনের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে চীনের শীর্ষ কূটনীতিকের মস্কো সফরে অনেকের কপালেই দুশ্চিন্তার রেখা দেখা যাচ্ছে।
রাশিয়াকে সমরাস্ত্র না দেওয়ার জন্য চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র শুধু আহ্বানই জানায়নি, বরং হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে এর ফলে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিতে পারে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর রাশিয়ার এ হস্তক্ষেপ অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর জন্য এক ভয়াবহ নজির। বৃহৎ শক্তিগুলোর রাজনৈতিক অভিলাষ চলমান যুদ্ধকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, সে দুর্ভাবনা থেকে তাই আপাতত কোনো পরিত্রাণ নেই।