রাশিয়াকে ঠেকাতেই কি তড়িঘড়ি আফগানিস্তান ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্র

দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া আফগানরা যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর পরিবহন উড়োজাহাজে ওঠার চেষ্টায়
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

যুক্তরাষ্ট্রের একটি সি-১৭ সামরিক উড়োজাহাজ কাবুল বিমানবন্দরে অবতরণ করল। দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া হাজারো আফগানের সেই উড়োজাহাজে ওঠার চেষ্টা। উড়োজাহাজ রানওয়ে ধরে চলা শুরু করার পরও অনেকে উড়োজাহাজের সঙ্গে দৌড়াচ্ছিলেন। কেউ ওই অবস্থাতেও দরজা আঁকড়ে ধরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কাউকে কাউকে ডানা ও চাকার ওপর ওঠার চেষ্টা করতে দেখা যায়। উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পরপরই দুজন ছিটকে পড়ে। এ দুজন ছিল কাবুলের তরমুজ বিক্রেতা সহোদর কিশোর।

এই দৃশ্য ২০২১ সালের আগস্টের। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীকে সহায়তাকারী আফগানদেরও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এর বাইরেও হাজারো আফগান দেশ ছাড়তে কতটা মরিয়া ছিলেন, তা এ দৃশ্য থেকে বোঝা যায়। বলা হচ্ছিল, ভিয়েতনামের পর এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গ্লানিময় ও বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহার।

ক্রিমিয়া দখল হয়ে যাওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যৎ সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করে ইউক্রেন। আর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেই থামবেন না—এটা ধরে নিয়ে নীরবে অস্ত্রসজ্জিত হতে থাকে ইউক্রেন। দেশটির কয়েকজন কর্মকর্তার পাশাপাশি ইউরোপীয় কয়েকজন নেতার মুখেও এ কথা শোনা যায়। তাঁদের ভাষায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা কার্যত ২০১৪ সাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে।

আফগানিস্তান ছাড়তে উড়োজাহাজের ডানা আর চাকায় চড়ে বসা আফগানদের চেয়ে কম মরিয়া ছিল না যুক্তরাষ্ট্রও। সেনা প্রত্যাহারে তালেবানের সঙ্গে করা চুক্তির বিষয়ে শেষ দিকে ওয়াশিংটনই দৃশ্যত বেশি আগ্রহী ছিল। এর রেশ পাওয়া যায় তড়িঘড়ি বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহারেও। কেন এত তাড়াহুড়ো? অন্য কারণ ছাড়াও নেপথ্যে কি সম্ভাব্য ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয় মাথায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের? এই যুদ্ধ নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সতর্কবাণী আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বক্তব্যে অন্তত সেটিরই ইঙ্গিত মিলে।

আগেই আঁচ পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র

ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের শুরুটা মূলত ২০১৪ সালেই। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বন্দুকধারীরা ক্রিমিয়া উপদ্বীপের স্থানীয় পার্লামেন্ট ও সরকারি ভবনগুলো দখল করে রুশ পতাকা ওড়ায়। মার্চে গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিজের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে নেয় রাশিয়া। উপদ্বীপটি ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করে ইউক্রেন।

ক্রিমিয়া দখল হয়ে যাওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যৎ সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করে ইউক্রেন। আর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেই থামবেন না—এটা ধরে নিয়ে নীরবে অস্ত্রসজ্জিত হতে থাকে ইউক্রেন। দেশটির কয়েকজন কর্মকর্তার পাশাপাশি ইউরোপীয় কয়েকজন নেতার মুখেও এ কথা শোনা যায়। তাঁদের ভাষায়, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধটা কার্যত ২০১৪ সাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে।

রুশ হামলার বর্ষপূর্তির আগে কিয়েভে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আলিঙ্গন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চুক্তি অনুসারে, পরের বছরের ১ মের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও বিদেশি সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেন, একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার ২০ বছর পূর্তির আগে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।

আগস্ট থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা আসতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে আফগান বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। মধ্য–আগস্টে ঝোড়ো গতিতে আক্রমণ চালিয়ে কাবুল দখল করে নেয় তালেবান। প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শেষ করতে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা হয় মার্কিন প্রশাসনের। শেষ পর্যন্ত ৩১ আগস্ট মধ্যরাতে সর্বশেষ মার্কিন উড়োজাহাজ কাবুল বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রত্যাহারের কাজ। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম থেকে সরে আসার গ্লানিময় ঘটনা ফের সামনে আনে। এরপরও বাড়তি কয়েক দিন সময় চায়নি যুক্তরাষ্ট্র।

সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ২০ বছরের আগ্রাসনের অবসান ঘটে। প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে সেনা হতাহত আর যুদ্ধে ব্যয়ের বিষয় সামনে আনে মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু তত দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এ যুদ্ধ ছিল অজেয়। শেষ দিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানকে অস্ত্র সহযোগিতার অভিযোগ তোলে ওয়াশিংটন। তবে তড়িঘড়ি প্রত্যাহারের নেপথ্যে যে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টিও ছিল, পরবর্তী সময়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে সেই ইঙ্গিতই মেলে।

কিয়েভে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিন লয়েড ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন (ডানে)

ব্লিঙ্কেনের ‘স্বীকারোক্তি’

রাশিয়ার সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের বিষয়ে ব্লিঙ্কেন ২০২১ সালের অক্টোবরেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ব্যক্তিগতভাবে জানান। অথচ রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করেছিল প্রায় চার মাস পর ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। অক্টোবরে জেলেনস্কিকে জানানোর মানে সম্ভাব্য হামলার তথ্য আরও আগেই হাতে পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবরে ইউরোপে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ফাঁকে জেলেনস্কিকে সম্ভাব্য রুশ হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নের বিষয়টি অবহিত করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ সময় জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘কোনো ধরনের পাল্টাযুক্তি ছাড়াই তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, যখন রাশিয়া (মহড়ার নামে) প্রকাশ্যে ইউক্রেনের সীমান্তে সেনা জড়ো করছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মস্কোর পরিকল্পনা সম্পর্কে ‘বিশেষে (গোয়েন্দা)’ তথ্য ছিল।

এরপর গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনেও একই ধরনের ইঙ্গিত দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে বলতে হয়, আমরা যদি এখনো আফগানিস্তানে থাকতাম, তবে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মিত্ররা ও আমরা ইউক্রেনকে যে সমর্থন দিতে সক্ষম হয়েছি, সেটা জটিল হতো।’

এ ছাড়া হামলা শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি খোদ প্রেসিডেন্ট বাইডেনও রুশ হামলার বিষয়ে জোর গলায় সতর্ক করতে থাকেন। শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মেলালেও আতঙ্ক সৃষ্টির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বিবেচনায় জেলেনস্কি হামলার বিষয়ে আগ বাড়িয়ে বলা থেকে বিরত থাকেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদেরও আগ বাড়িয়ে কিছু না বলার আহ্বান জানান। পরবর্তী সময়ে এ জন্য বাইডেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, হামলার বিষয়ে তাঁর পূর্বসতর্কতা কানে তোলেননি জেলেনস্কি।

আফগানিস্তান থেকে সরে আসা কেন জরুরি ছিল

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। দুই দশকের লড়াইয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছে এই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। নিয়মিত বিরতিতে দেশটির সেনারাও হতাহত হচ্ছিলেন। রাজধানী কাবুলসহ শহরকেন্দ্রিক অবস্থান ছাড়া আফগানিস্তানে মার্কিন ও আফগান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তেমন ছিল না। সরকারের পাশাপাশি আফগান বাহিনীতে দুর্নীতি ও জাতিগত বিভক্তি প্রকট ছিল। এ যুদ্ধের তহবিল জোগান দেওয়া ওয়াশিংটনের বড় মাথাব্যথা ছিল।

রুশ হামলা ‍শুরুর পর ইউক্রেনের জন্য বৈশ্বিক সমর্থন আদায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিয়েভকে সমর্থন দিতে দ্রুততার সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক জোট গড়ে তোলে ওয়াশিংটন। বেশ কটি দেশের দেওয়া সহায়তারও সমন্বয় করছে দেশটি। যুদ্ধের এক বছরে ইউক্রেনকে ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সহায়তার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এ তথ্য দিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিন লয়েড। মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে থাকলে ইউক্রেনকে এভাবে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হতো না।

শেষের দিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার জোরালো অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এমন অভিযোগ বরাবরের মতো অস্বীকার করে আসে মস্কো। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী এখনো অবস্থান করলে তালেবান নীতিতে মস্কো বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারত।

তালেবান রুশ অস্ত্র হাতে পেলে তা মার্কিন বাহিনীর জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে যত বেশি সম্ভব নিজেদের যুক্ত করতে ও রাশিয়া-তালেবান সম্ভাব্য জোটের মুখোমুখি হওয়া এড়াতেই আফগানিস্তান ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি আপত্তি ও উদ্বেগ সত্ত্বেও ইরাক এবং সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইও সীমিত করে ফেলে ওয়াশিংটন। এর পেছনেও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পরোক্ষ ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।

তথ্যসূত্র: এএফপি, আল-জাজিরা, তাস, আরটি