পুতিনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা, বুশ-ব্লেয়ারের কী হবে

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ফাইল ছবি: এএফপি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।

এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই অনেকগুলো দেশের সরকারের অপরাধ, অনেকগুলো দেশের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর নাম যেমন আসে তেমনি আসে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাম। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্মকাণ্ডে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে ইউক্রেনের ওপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে সামরিক অভিযান চালানোর নাম করে কী কী হচ্ছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে সেটা সবারই জানা। পাঠকেরা এটাও জানেন যে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার ধরন পাল্টিয়েছে। এর কারণে এখনো ভুগছেন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ। সেখানে সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

আবার শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকে কাবু করতে ইউক্রেনের বৈদ্যুতিক স্থাপনা, বাড়িঘর উষ্ণ রাখার তাপ সরবরাহ ব্যবস্থায় (হিটিং সিস্টেম) হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। এমনকি যেখানে যুদ্ধক্ষেত্র ৭০০, হাজার কিলোমিটার দূরে বেসামরিক স্থাপনাতেও রুশ বাহিনীর গোলা পড়ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করলে, প্রেসিডেন্ট পুতিন কতটা দায়ী, সেটা বোঝা সহজ হয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাঁর ওয়েবসাইটে যে সজ্ঞায়ন বা ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা অনুসারে যুদ্ধের সময় নির্যাতন, অঙ্গচ্ছেদ, শারীরিক শাস্তি, জিম্মি করা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড—এসব যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে। আবার মানুষের মর্যাদাহানিকর কর্মকাণ্ডে যেমন ধর্ষণ, জোর করে পতিতাবৃত্তি; লুটপাট, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে এবং এসব ঘটনার বিচারিক ক্ষমতা আইসিসির রয়েছে। আবার গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক ক্ষমতাও রয়েছে আইসিসির।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ

কোন অপরাধগুলো যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে জাতিসংঘের ওয়েব সাইটে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে অনুসারে যুদ্ধাপরাধ চিহ্নিত হয়। যে ‘রোম সংবিধির’ ওপর ভিত্তি করে আইসিসি প্রতিষ্ঠিত সেই সংবিধির অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃত হত্যা, নির্যাতন বা অমানবিক আচরণও যুদ্ধাপরাধের শামিল। যুদ্ধবন্দী নির্যাতন, বেআইনি নির্বাসন বা স্থানান্তর বা বেআইনি বন্দিত্বও এই অপরাধের শামিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের দিকে নজর ফেরালে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, পুতিন এসব অপরাধ করেছেন কি না।

নজর এবার একটু অন্য দিকে দেওয়া যেতে পারে। সেটা হলো, সন্ত্রাসবাদ দমন করতে গিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমারা কি যুদ্ধাপরাধ করেছে? যদি সেটা করতে থাকে, তবে সে জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানাচ্ছে, জঙ্গিসংগঠন আল-কায়েদাকে সাহায্য করছে—   এসব অভিযোগ তুলে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। ‘সন্ত্রাসবাদ দমন’—বিশ্বজুড়ে এই শব্দবন্ধের প্রচল হয় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের যুক্তরাষ্ট্রে সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে। এর জেরেই মূলত ইরাকে হামলা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুসারে, ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ৬ হাজার মানুষ এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা রবার্ট ইনলাকেশের মতে, মার্কিন হামলায় ১০ লাখেরও বেশি ইরাকি নিহত হয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার

সংখ্যাটা যতই হোক, তা দিয়ে আসলে হামলার বৈধতা পাওয়া যায় না। কারণ, যে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছিল, সেই ইরাক সরকারের সঙ্গে আল-কায়েদার সংশ্লিষ্টতা সেই সময় পাওয়া যায়নি। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন তদন্ত প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, ওই হামলা চালানোর ক্ষেত্রে আল-কায়েদার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের সরকারের কোনো ‘সহযোগিতামূলক কার্যকর কোনো সম্পর্ক’ ছিল না।
যুদ্ধে ইরাকে সাধারণ মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে কারাগারে বন্দী নির্যাতনের অহরহ ঘটনা ঘটেছে। ইরাকের আবু গারিব কারাগারের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেখানে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা ছিল বহুল চর্চিত বিষয়। সময়ের ব্যবধানে সেসব ঘটনা চোখের সামনে থেকে সরে গেছে। কিন্তু ইরাকে হামলার জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কী হবে?

ইরাকে হামলার পর থেকেই জর্জ ডব্লিউ বুশকে যুদ্ধাপরাধী বলে সম্বোধন করা হয়। এটা যে পশ্চিমা বিরোধীরা বলেন এমনটা নয়। খোদ মার্কিন মুলুকের মানুষেরাও তাঁকে এটা সম্বোধন করে থাকেন। গত বছর ইরাকযুদ্ধ নিয়ে এক ভুল মন্তব্য করার জেরে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের সিনেটর নিনা টার্নার বলেছিলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ একজন যুদ্ধাপরাধী।
একই রকম ‘মিথ্যা’ তথ্য দিয়ে ইরাকে হামলায় যোগ দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। এই যুদ্ধে যুক্তরাজ্যের সম্পৃক্ততা নিয়ে একটি তদন্ত করা হয়েছিল। ‘চিলকট রিপোর্ট’ নামে ঐতিহাসিক ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরাকে হামলা কোনো যৌক্তিক বিবেচনার ভিত্তিতে ছিল না। দেশটিকে নিরস্ত্র করার শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো পাশ কাটিয়ে ওই হামলা চালানো হয়।

সেই সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন টনি ব্লেয়ার। তাঁর উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন জন প্রেসকট। তিনি এই যুদ্ধের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। এমনকি ব্লেয়ারের দল লেবার পার্টিও ক্ষমা চেয়েছিল (ইরাক যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তিদের কাছে লেবার পার্টির নেতা জেরমি করবিন দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলেন)। কিন্তু ব্লেয়ারের কী হবে?

ইরাকে যুদ্ধে সঙ্গে আসে আফগানিস্তানে হামলার কথা। সেখানেও আল-কায়েদা দমনের কথা বলে হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। হোয়াইট হাউসের প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়েছে, আফগানিস্তানের বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করতে এবং তাদের সরঞ্জাম বাবদ যুক্তরাষ্ট্র এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। কিন্তু যে তালেবানকে হটিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমারা সেই তালেবানের হাতেই আবার ক্ষমতা গেছে। মাঝ থেকে মারা পড়েছেন সাধারণ মানুষেরা। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনেই মার্কিন বাহিনীর অপরাধের কথা উঠে এসেছে। সেখানে হত্যা, বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, নির্যাতন—হেন কোনো অপরাধ নেই যে পশ্চিমা বাহিনীরা করেনি।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ৬৯ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে আফগান বেসামরিক মানুষ মারা গেছে ৫১ হাজার বেশি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাড়ে তিন হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন। ২০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এই যুদ্ধে আহত হয়েছেন। কোটির বেশি মানুষ এই যুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়েছেন।

সৌদি আরবের ক্ষমতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

ইয়েমেনবাসী কী বিচার পাবে

মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দেশ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেটি হলো ইয়েমেন। এই গৃহযুদ্ধে আবার নতুন আরেক শক্তি নজরে আসে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন বাহিনী নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে সেখানে। অবাক করা ব্যাপার হলো, ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী চালিয়েছে। এ হামলা মানবিক বিপর্যয়কে এক চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ে গেছে।

তিন কোটি জনবসতির এই দেশে মারা পড়েছে তিন লাখের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের হিসাবে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে। আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, ইয়েমেন যুদ্ধ ও যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কারণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।

যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ৪৫ শতাংশই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই ‘নিরাপত্তাহীন’ একটি মার্জিত শব্দ আসলে। লক্ষ্য করে থাকবেন, সেখানকার দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশুদের দিকে তাকানো বেশ কষ্টসাধ্য। ইয়েমেনে এমন অনেক শিশুর ছবি পাওয়া যায়, গণমাধ্যমে প্রকাশ করাও কঠিন। গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশ করাও কঠিন এমন অনেক ঘটনা আফগানিস্তান, ইরাকেও ঘটেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমই এমন ঘটনা প্রকাশ করেছে। কিন্তু পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো নয়।

আবারও প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আইসিসি বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো থেকে শিশুদের বেআইনিভাবে রাশিয়ায় সরিয়ে নেওয়া ও বাস্তুচ্যুত করার সঙ্গে পুতিন জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ জন্য তাঁকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু আদৌ তাঁর কী হবে, সেটা অজানা।

যেকোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। সেই বিবেচনায় রুশ প্রেসিডেন্টকে বিচারের আওতায় আনা অনেক বড় ঘটনা। আবার এমন অপরাধ বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন ওঠে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, যুক্তরাষ্ট্র সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, সৌদি আরব বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ কিংবা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে কী বিচারের আওতায় আনতে দেখা যাবে?