ঝড় সামলে ঐতিহ্য টিকিয়েছেন রানি

রানি অভূতপূর্ব দক্ষতায় সব ঝড় সামাল দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছিলেন। নিজেকে বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতিকৃতির সামনে সাদা গোলাপ রেখে শ্রদ্ধা। গতকাল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ব্রিটিশ দূতাবাসে

গত ৭০ বছরে বিশ্বজুড়ে নানা রকম উত্থান-পতন ঘটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রযুক্তিতাড়িত জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। এত কিছুর মধ্যেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। পরিবর্তন শুধু বিশ্বের অন্যান্য দেশে নয়, যুক্তরাজ্যেও রাজতন্ত্র সংকটের মুখে পড়েছে। কিন্তু রানি এলিজাবেথ এক অভূতপূর্ব দক্ষতায় সব ঢেউ সামাল দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। কীভাবে তা সম্ভব হয়েছে, এ প্রশ্নের জবাবে মোটামুটি ঐকমত্য হচ্ছে, তিনি সতর্কতার সঙ্গে এবং বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ববোধ, নিয়ম মেনে চলা এবং ব্যক্তিগত ভাবনা প্রকাশে রক্ষণশীলতা তাঁকে পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে সাহায্য করেছে।

৯৬ বছর আগে যখন এলিজাবেথের জন্ম, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কে বলা হতো, ওই সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডোবে না। ৬০ কোটি মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল সে সাম্রাজ্যের। কিন্তু তিনি রাজসিংহাসনে আসীন হওয়ার পাঁচ বছর আগেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। অবশ্য তখনো আফ্রিকার বিরাট অংশজুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ বজায় ছিল। যার প্রায় সব কটি পরে স্বাধীন হয়েছে। তাঁর রাজত্বকালে প্রথম স্বাধীন হয় ঘানা, ১৯৫৭ সালে। আর জীবদ্দশায় শেষ প্রজাতন্ত্র হয় ক্যারিবীয় দেশ বার্বাডোজ, গত বছরের নভেম্বরে। ওই সব রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতায় রানি নিজে উপস্থিত থাকেননি, কিন্তু রাজপরিবারের প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, যাঁর উপস্থিতিতে ব্রিটিশ পতাকা নামানো হয়েছে। তবে এসব রাষ্ট্র স্বাধীন হলেও প্রায় সবাই কমনওয়েলথ জোটের সদস্যপদ গ্রহণ করে রানির একটি আলংকারিক অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছে।

সাবেক উপনিবেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে রানির বিশেষ আগ্রহের প্রতিফলন দেখা গেছে। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের ২৫তম, ৫০তম ও ৭৫তম বার্ষিকীতে ওই সব দেশে তিনি নিজে অথবা রাজপরিবারের কোনো একজন সদস্য বিশেষ সফরে গেছেন। রানির মৃত্যুর খবর গতকাল শুক্রবার কেনিয়ার সংবাদপত্রগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছে, তা প্রায় ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। রাজা ষষ্ঠ জর্জ যখন মারা যান, তখন এলিজাবেথ কেনিয়ায় সফরে ছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরেই তিনি সিংহাসনে আসীন হন। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী উইলিয়াম রুটো রানির ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের প্রশংসা করে বলেছেন, কেনিয়ার মানুষ দেশটির সঙ্গে রানির আন্তরিক সম্পর্কের অভাব বোধ করবে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসা স্মরণ করেছেন রানির সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার কথা। উপনিবেশ-উত্তরকালে সাবেক উপনিবেশগুলোর নেতৃত্ব ও জনগণের সঙ্গে যোগসূত্র ধরে রাখার এ কৃতিত্বকে অনন্য হিসেবে মানতেই হয়।

কমনওয়েলথের নেতাদের আনুষ্ঠানিক শোকবার্তায় রানির ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সময়ের সহযোগিতার উষ্ণতার কথা উঠে এসেছে। তিনি কমনওয়েলথের প্রায় সব কটি দেশ সফর করেছেন এবং একধরনের যোগসূত্র ধরে রেখেছেন। কমনওয়েলথের বাইরে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনেতারাও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তাঁকে ‘একজন সম্রাজ্ঞীর চেয়েও বেশি কিছু, একটি যুগের নির্মাতা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেছেন, ব্রিটেনকে বিশ্বের টালমাটাল সময়ে নেতৃত্ব দেওয়া রানির মৃত্যু শুধু ব্রিটিশ জনগণের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটা বিশাল ক্ষতি।

ব্রিটিশ রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে শুধু রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন, তা নয়, তিনি ছিলেন খ্রিষ্টধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট শাখার প্রধান। ২০১১ সালে রানি আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র সফর করেন। ক্যাথলিকপ্রধান আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সহিংসতার রক্তাক্ত ইতিহাসের পটভূমিতে ওই সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রানির সেই সফরের সৌজন্যের কথা স্মরণ করে তাঁর সময়কালকে ‘ঐতিহাসিক সময়’ ও তাঁর চলে যাওয়াকে ‘একটি যুগের অবসান’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিচেল মার্টিন।

সুয়েজ সংকট, শীতল যুদ্ধ, বার্লিন দেয়ালের পতন, ফকল্যান্ড যুদ্ধ, নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলা ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ ও কোভিড মহামারি—এসবই তাঁর জীবদ্দশায় ঘটেছে। তাঁর সময়েই যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে, আবার তাঁর আমলেই ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদ। এসব রাজনৈতিক বিষয়ে রানি কখনোই কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়েছে পার্লামেন্টে। তাঁর শাসনামলে শুধু যুক্তরাজ্যেই ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন, তা-ই নয়, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডায়ও প্রায় সমসংখ্যক প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। তিনি ওই দেশগুলোরও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।

রানি এলিজাবেথ উত্তাল সময়ের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন কর্তব্যপরায়ণতা ও নিয়ম মেনে চলার কারণে। কোভিড মহামারির সময়ে যখন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আইন ভেঙে ডাউনিং স্ট্রিটে একের পর এক পার্টি করে কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছেন, তখন সরকারি আইন মেনে গির্জার এক কোনায় একাকী বসে রানি তাঁর ৭৩ বছরের জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন।

ষাটের দশকে রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আনুগত্যে কিছুটা বদল আসতে শুরু করে। হ্যারল্ড ম্যাকমিলান ১৯৬৩ সালে পদত্যাগ করার পর একটা সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয় এবং রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন রানি এলিজাবেথ। সেই সময় রানি ও রাজতন্ত্রকে সরকারের দৈনন্দিন কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রানিও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। রানির দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা এবং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে।

এরপর নব্বইয়ের দশক ছিল রাজপরিবারের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। রাজপরিবারে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানির দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপসের বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স চার্লস ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীরভাবে অসুখী, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। রানির প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর ক্যাসলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সরকার বহন করবে, নাকি রানির নিজের সম্পদ থেকে ব্যয় করা উচিত, তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।

জনমনে এ রকম বিতর্কের মধ্যেও যখন রানি রাজপরিবারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা যাওয়ার পর রানির বিরুদ্ধে ওঠে সমালোচনার ঝড়। রাজতন্ত্রের সমর্থক পত্রিকাতেও ‘রানি কোথায়’ শিরোনাম হয়।

মানুষের উত্তাল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পুত্রবধূ ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং রাজপরিবার শিক্ষা গ্রহণ করবে বলে ঘোষণা করেন।

তবে সম্প্রতি রানির আরেক পুত্র রাজকুমার এন্ড্রুর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা নিয়ে কেলেঙ্কারি ফাঁস হলে তা রানির জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করে। রানি প্রিন্স এন্ড্রুর সামরিক মর্যাদা কেড়ে নেন এবং রাজকীয় দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। একইভাবে রানির প্রপৌত্র প্রিন্স হ্যারির অশ্বেতাঙ্গ প্রেমিকাকে বিয়ে করা নিয়ে রাজপরিবারের ভেতরের অনেক অপ্রিয় কথা হ্যারি ও স্ত্রী মেগান মেরকেল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ায় বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি হয়। হ্যারি ও মেগান জুটি রাজপরিবারের সব সুযোগ-সুবিধা হারান এবং যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

এসব বিতর্ক রাজতন্ত্রের জন্য সাময়িক চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও রানি তা বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করেন। তাঁর রাজ্যশাসনের ৭০ বছর পূর্তির উৎসবে রাজপরিবারের প্রতি অবিশ্বাস্য রকম সমর্থনের প্রতিফলন ঘটে। রানির মৃত্যু রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটিশ জনগণের ভালোবাসায় নতুন প্রাণশক্তি জোগাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে তাঁর উত্তরসূরি রাজা তৃতীয় চার্লসের বিষয়ে সবাই যে শতভাগ আস্থাবান, তা বলা যাবে না। সরকারি কাজে হস্তক্ষেপের চেষ্টার অতীত অভিযোগ অনেকের সংশয়ের কারণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্যান্য দেশে রাজপরিবারের অবস্থান কী হবে, সে প্রশ্নও উপেক্ষণীয় নয়। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিন পার্টি ইতিমধ্যে দেশটিকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছে। তবে প্রজাতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, এখনই এ আলাপের সময় নয়।