যুদ্ধে হার–জিত যা–ই হোক, মস্কোর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা রাখবে বেইজিং’

প্রতিকূলতার মধ্যেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে রয়েছে চীন
ছবি: রয়টার্স

সময় যতই গড়াচ্ছে, ইউক্রেনে যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ার সাফল্য যেন ফিকে হয়ে আসছে। সর্বশেষ দেশটির উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পিছু হটার খবর এসেছে। এতে করে আগে থেকেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে থাকা রাশিয়া যেন আরও বিপাকে পড়েছে। তবে এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে রয়েছে চীন। দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেছেন, মস্কোকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়তে চায় বেইজিং। গত সোমবার চীনে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই দেনিসভের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ইয়াং জিচি এ কথা বলেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন দেয়নি বেইজিং। তারপরও যুদ্ধ চলাকালীন গত ছয় মাসে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর করেছে। রাশিয়ার ‘সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা’ রক্ষায় চীন সমর্থন দিয়ে যাবে—পুতিনকে এমন নিশ্চয়তাও দিয়েছেন সি চিন পিং।  

এরই মধ্যে বিশ্লেষকেরাও বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দৃঢ় হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক। মস্কো ও বেইজিংয়ের ভাষ্যমতে, দুই দেশের বন্ধুত্বে কোনো ‘শেষ সীমা’ নেই। এই সম্পর্ক আরও সামনে এগিয়ে নিতে চলতি সপ্তাহে উজবেকিস্তানে দেখা করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পশ্চিমারা যখন মস্কোকে একঘরে করতে চাচ্ছে, তখন দুই রাষ্ট্রপ্রধানের এই সাক্ষাৎকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন দেয়নি বেইজিং। তারপরও যুদ্ধ চলাকালীন গত ছয় মাসে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর করেছে। রাশিয়ার ‘সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা’ রক্ষায় চীন সমর্থন দিয়ে যাবে—পুতিনকে এমন নিশ্চয়তাও দিয়েছেন সি চিন পিং।

লি ঝানশুয়ের রাশিয়া সফরের দিকে একটু গভীরভাবে নজর দিলে এটা পরিষ্কার যে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চাইছে চীন, যদিও মস্কো তাদের ইউক্রেন অভিযানের সমর্থক হিসেবে বেইজিংকে তুলে ধরেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যখন তলানিতে, তখন বেইজিং চাচ্ছে প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের চীনবিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জয়লাভ করুক অথবা পরাজিত হোক, মস্কোর সঙ্গে বেইজিং ঘনিষ্ঠতা রেখেই চলবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।

ইউন সানের ভাষ্যমতে, যেহেতু রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, তাই তারা এমন কোনো ভূরাজনৈতিক শক্তি না যে চাইলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে।  

‘ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জয়লাভ করুক অথবা পরাজিত হোক, মস্কোর সঙ্গে বেইজিং ঘনিষ্ঠতা রেখেই চলবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।’
ইউন সান, স্টিমসন সেন্টারের চীনবিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক

ওয়াশিংটনের আধিপত্যের বলয়ের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে রাশিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে চীন। সোমবারই চীনের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ইয়িং রুশ রাষ্ট্রদূত দেনিসভকে বলেন, ‘বিশ্বব্যবস্থার উন্নয়ন আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে’ একসঙ্গে কাজ করতে পারেন পুতিন ও সি চিন পিং।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইয়াং বলেন, দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতার অনন্য উচ্চতায় নিতে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করে যেতে চায় চীন। তারা এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেটা আরও ন্যায়সংগত ও যুক্তিযুক্ত দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হবে। জবাবে দেসিনভ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কার্যকর অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসা করেন।

আর বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিক দিয়ে দেখলে, গত কয়েক মাসে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ বাড়িয়েছে চীন। চলতি বছরের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন মাস চীনে তেল সরবরাহকারীদের তালিকায় শীর্ষে ছিল রাশিয়া। এতে চীনের যেমন লাভ হয়েছে, রাশিয়াও নিজেদের ক্ষতি কমাতে পেরেছে।

চীন–যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে আবার বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে ওয়াশিংটন।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের মধ্য দিয়ে চীন–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে মনে করে বেইজিং। ফলে পেলোসির সফর ঘিরে ওই অঞ্চলে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। তাইওয়ান ঘিরে ব্যাপক সামরিক মহড়া চালায় চীন। এ ছাড়া জলবায়ুসংক্রান্ত আলোচনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পাশ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় তারা।

এরই মধ্যে গত সপ্তাহে পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে চীনের শীর্ষ আইনপ্রণেতা লি ঝানশুকে রাশিয়ায় পাঠান সি চিন পিং। লি ঝানশু বলেন, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা, কৌশলগত সমন্বয় ও বাস্তব সহযোগিতা অভূতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে লি ঝানশুর ওই মন্তব্য প্রকাশ করা হয়।

আশাবাদী রাশিয়া

লি ঝানশুয়ের রাশিয়া সফরের দিকে একটু গভীরভাবে নজর দিলে এটা পরিষ্কার যে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চাইছে চীন, যদিও মস্কো তাদের ইউক্রেন অভিযানের সমর্থক হিসেবে বেইজিংকে তুলে ধরেছে।

রাশিয়ার পার্লামেন্টে দেওয়া এক বক্তব্যে দাবি করা হয়, লি ঝানশু বলেছেন, ‘রাশিয়া নিজেদের প্রধান স্বার্থগুলো রক্ষা করতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারছি। আমরা আমাদের সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তবে লি ঝানশুর ওই বক্তব্য চীনের সরকারি প্রতিবেদনগুলোতে প্রকাশ করা হয়নি।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের অধ্যাপক হ্যাল ব্র্যান্ডস টুইটারে লেখেন, ‘রাশিয়ার অবস্থান যতই খারাপ হবে, পুতিন ততই চীনের বাড়তি সহায়তার জন্য তাকিয়ে থাকবেন।’

পুতিন ও সির শেষ দেখা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। সেবার পুতিন বেইজিং সফরে গিয়েছিলেন। ওই সফরেই দুই প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের কোনো ‘শেষ সীমা’ নেই।

চলতি সপ্তাহেই উজবেকিস্তানে আবার তাঁদের সাক্ষাৎ হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে ওয়াশিংটনের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক অধ্যাপক জোসেফ টোরিজিয়ান এএফপিকে বলেন, ‘এই সাক্ষাৎ এমন সময় হচ্ছে, যখন যুদ্ধক্ষেত্রে খারাপ অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। এর অর্থ এমন হতে পারে, চীনের সহায়তার জন্য আশাবাদী হয়ে আছে মস্কো। আমরা জানি না রাশিয়া কতটা সহায়তা চাইবে, আর নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ করা ছাড়াই চীন কতটা দেওয়ার কথা ভাবছে।’