এ মাসের শুরুর দিকে প্রাগে একটি বাস গ্যারেজ পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল কেউ। অবশ্য তা ব্যর্থ হয়েছিল। বিষয়টি সবার নজরে আসেনি। তবে চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী পেত্র ফিয়ালা যখন বললেন, এর পেছনে মস্কোর হাত থাকতে পারে, তখন এর গুরুত্ব বেড়ে গেল।
চেক প্রধানমন্ত্রীর করা অভিযোগটি নিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে গেছে। কারণ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরোপজুড়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে লাটভিয়ার রিগায় একটি জাদুঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়। গত মার্চে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি গুদাম পুড়ে যায়। মে মাসে পোল্যান্ডের ওয়ারশতে একটি বিপণিবিতানে আগুন লাগে। এপ্রিলে জার্মানির পুলিশ বিস্ফোরণ পরিকল্পনার অভিযোগে কয়েকজনকে আটক করে। ফ্রান্সেও বোমা তৈরিতে যুক্ত রয়েছেন সন্দেহে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ইউরোপের কয়েকটি দেশে একাধিক হ্যাকিং আক্রমণ ও গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনাও ঘটেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া ও বেলারুশের বিরুদ্ধে অভিবাসী আশ্রয়প্রার্থীদের অস্ত্র দেওয়ার ও সীমান্তে বিশৃঙ্খলা চেষ্টার অভিযোগ এনেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ বেড়েছে।
এ ধরনের হামলাগুলোর একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ ধরনের হামলাগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এগুলো আদতে দেখতে ছোট ও বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এগুলো একসঙ্গে জুড়ে নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞরা একে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সংকর (হাইব্রিড) যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
গত সপ্তাহে কানাডায় এক অনুষ্ঠানে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব ইয়ানেস স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘আমরা এমন কিছু হুমকির সম্মুখীন, যা সম্পূর্ণ সামরিক হামলা নয়, যেগুলোর মধ্যে এ ধরনের সংকর হুমকি রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর আস্থা নষ্ট করে দেওয়া, ভুয়া তথ্য ছড়ানো, সাইবার আক্রমণ এবং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মতো ঘটনা রয়েছে।’
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সংস্থাগুলোর আস্থা নষ্ট করে দেওয়া, ভুয়া তথ্য ছড়ানো, সাইবার আক্রমণ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটছে।
যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা অধ্যয়নবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক রড থর্নটন বলেন, এসব হামলার একটি ধরন রয়েছে, যা রাশিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। এ ধরনের নির্দিষ্ট হামলা গত কয়েক মাসে বেড়ে গেছে। এ ধরনের হামলা রাশিয়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ ধরনের কোনো আক্রমণের দায় স্বীকার করেনি রাশিয়া। এ নিয়ে সিএনএনকে কোনো মন্তব্যও করেনি মস্কো। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধকে ন্যাটোর সঙ্গে একটি বৃহত্তর সংঘাতের অংশ হিসেবে দেখেন। রাশিয়া কিয়েভের সরকারকে পশ্চিমের একটি নিছক ছায়া সরকার (প্রক্সি) হিসেবে দেখে। পশ্চিমারা ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা বা মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে সামরিক হামলার হুমকি বাড়ানো হয়েছে।
রড থর্নটন বলেন, ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা তাদের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে। তাই ন্যাটোর বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধের পরিবর্তে রাশিয়া নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে।
থর্নটন আরও বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ন্যাটোর মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। কারণ, ন্যাটোর বাহিনীর কাছে তাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর পরিবর্তে তারা সেনা সংঘাত বা সরাসরি হামলার মধ্যে পড়ে না, এমন কৌশল বেছে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ন্যাটোর আর্টিকেল-৫ প্রতিক্রিয়া এড়াতে পারছে। আর্টিকেল-৫ হচ্ছে সেই মূলনীতি, যেখানে ন্যাটোর কোনো সদস্যকে আক্রমণ, অর্থাৎ পুরো ন্যাটোকে আক্রমণের মধ্যে পড়ে। এর আগে সর্বশেষ নাইন–ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে আল–কায়েদার হামলার সময় আর্টিকেল-৫ কার্যকর হয়েছিল।
থর্নটন বলেন, সশস্ত্র সংঘাত না বাধিয়ে রাশিয়া ন্যাটোর মধ্যে আরও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। কারণ, এভাবে আক্রমণ চালালে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার কোনো স্পষ্ট নীলনকশা ন্যাটোর নেই।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের রাশিয়াবিষয়ক গবেষক নিকোল ওলকভ বলেন, রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য এখন ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক সাহায্যের প্রবাহকে ব্যাহত করা। এসব কার্যক্রম ইউক্রেনকে সমর্থন করার পশ্চিমা সংকল্পকে দুর্বল করতে এবং পশ্চিমের মধ্যে ঐক্যকে দুর্বল করার জন্য রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টার অংশ। তিনি সতর্ক করে বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়া আরও সরাসরি সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
ন্যাটোর মধ্যে আরও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে রাশিয়া। কারণ, কীভাবে এর জবাব দেবে ন্যাটো, তার কোনো স্পষ্ট নীলনকশা তাদের নেই।
ওলকভ বলেন, রাশিয়া যুদ্ধের আগে থেকেই এবং ন্যাটোর সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘর্ষের জন্য তার প্রচলিত সামরিক সক্ষমতা উন্নত করতে এ ধরনের যুদ্ধকৌশল নিয়ে কাজ করে আসছে।
রাশিয়া পর্যবেক্ষকেরা বলেন, ২০২০ সাল থেকে রাশিয়া এ ধরনের যুদ্ধকৌশল বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব বাড়াতে শুরু করে। ওই সময় কুখ্যাত গোয়েন্দা কমান্ডার আন্দ্রেই আভিরিয়ানভকে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টি এরই ইঙ্গিত দেয়।
ন্যাটোর পক্ষ থেকে কয়েক মাস ধরেই পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার অপ্রচলিত যুদ্ধকৌশলের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু এর আগে ইউরোপের নেতারা এ নিয়ে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে দ্বিধায় ছিলেন। নিরাপত্তা–গবেষক ওলগা লাউটম্যান বলেন, দায়বদ্ধতা না থাকায় মস্কো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাহসী হয়ে উঠেছে।