পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর অনুমতি পেয়েছে ইউক্রেন। এখন প্রশ্ন, এই অনুমতি কি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো পরিবর্তন আনবে বা সম্মুখসারির লড়াইয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে?
এত দিন পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করে শুধু ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ও ইউক্রেনের ভেতরে শত্রুদের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছিল দেশটির সামরিক বাহিনী। পশ্চিমাদের একটা ভয় ছিল, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তের ওপারে তাদের অস্ত্র ব্যবহার করা হলে চলমান সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে সম্প্রতি ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব খারকিভ অঞ্চলে রুশ বাহিনীর অগ্রগতির পর চিত্রপটে বদল এসেছে। কিয়েভের মিত্রদেশগুলো এখন বুঝতে পেরেছে, নিজেদের সুরক্ষার জন্য ইউক্রেনকে এখন সীমান্তের ওপারের সামরিক স্থাপনাগুলোও ধ্বংস করতে হবে।
গত মাসে খারকিভ অঞ্চলে ব্যাপক স্থল অভিযান চালায় রাশিয়া। এ সময় বেশ কয়েকটি গ্রাম তাদের দখলে যায়। রাশিয়ার এই অগ্রগতিতে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে এ অঞ্চলের রাজধানী খারকিভ শহর। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহর রুশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে।
এই সীমান্ত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের একটি সম্মুখসারিও। এত দিন অনুমতি না পাওয়ায় সীমান্তের ওপারে রুশ বাহিনীর ওপর পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারছিল না ইউক্রেন। এর ফলে সেখান থেকে একপ্রকার নিরাপদেই ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাশিয়ার সেনারা।
রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর মার্কিন অনুমতি ইউক্রেনকে ‘গ্লাইড বোমা’ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। সোভিয়েত আমলের পুরোনো বোমা উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত করা এই বোমাগুলো স্থানীয়ভাবে কেএবি নামে পরিচিত। খারকিভসহ ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অন্যান্য অঞ্চলে নিয়মিত এই বোমা ফেলছে রাশিয়া।
এমনই এক পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর চাপের মধ্যে নিজেদের সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর অনুমতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার প্রাগে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর একটি বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এ অনুমতির বিষয়টি খোলাসা করেন।
যদিও কিছুদিন আগেই এ নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছিলেন, ন্যাটো দেশগুলোর এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে তাদের দেশগুলোর আয়তন কম, কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ। পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর আগে তাদের এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
রাশিয়ার এসব হুমকির কথা মাথায় রেখেই হয়তো দেশটির ভেতরে নিজেদের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতির ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন তাদের তৈরি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘এটিএসিএমএস’ দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালাতে পারবে না ইউক্রেন। ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দিয়ে রাশিয়ার বেশ ভেতরের সেনা ও বিমানঘাঁটিগুলোতে হামলা চালানো সম্ভব।
এ ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে ইউক্রেনের সামনে একটি পথই খোলা—রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে হামলা চালানো। কিয়েভের হাতে থাকা হাইমার্সের মতো সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে রুশ সেনাদের চলাচল এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহ কার্যক্রমে বাধা দিতে পারে। এতে করে রাশিয়ার যেকোনো হামলার গতি কমে যেতে পারে।
খারকিভের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ইউক্রেনের সামরিক অভিযান সমন্বয়কারী দলের সদস্য ইউরি পোভখ বলেন, এখন ইউক্রেনের সেনারা ওই সব এলাকায় আঘাত হানতে পারেন, ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য যেখানে সেনা, সামরিক সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জড়ো করে রেখেছে শত্রুপক্ষ।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, আরেকটি হামলা চালানোর জন্য খারকিভ থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরে সেনাসদস্যদের জড়ো করছে মস্কো। আর স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা চিত্র বিশ্লেষণ করে মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ার জানিয়েছে, ওই এলাকায় রুশ বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেছে। তাই সেখানে যদি পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো যায়, তাহলে খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়ার নতুন কোনো হামলা ঠেকিয়ে দিতে সফল হবে ইউক্রেন।
বর্তমানে ইউক্রেনের হাতে থাকা স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দেশটির সু-২৪এস যুদ্ধবিমানে যুক্ত করা আছে। হামলা চালাতে হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধবিমানগুলোকে রুশ সীমান্তের কাছে যেতে হবে। এতে করে সেগুলো রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সহজ নিশানায় পরিণত হতে পারে।
যদিও রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর মার্কিন অনুমতি ইউক্রেনকে ‘গ্লাইড বোমা’ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। সোভিয়েত আমলের পুরোনো বোমা উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত করা এই বোমাগুলো স্থানীয়ভাবে কেএবি নামে পরিচিত। খারকিভসহ ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অন্যান্য অঞ্চলে নিয়মিত এই বোমা ফেলছে রাশিয়া। এতে ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। গ্লাইড বোমা থেকে রক্ষা পেতে হলে কিয়েভকে এসব বোমাবাহী যুদ্ধবিমানগুলোতে হামলা চালাতে হবে।
বোমাবাহী এই যুদ্ধবিমানগুলোকে থামাতে সক্ষম একটি অস্ত্রই ইউক্রেনের হাতে আছে। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘প্যাট্রিয়ট’, এর দামও অনেক। খারকিভের কাছাকাছি এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনে বড় ঝুঁকি রয়েছে। রাশিয়ার ড্রোনগুলো নিমেষেই সেগুলোর অবস্থান শনাক্ত করতে পারে এবং ইস্কান্দারের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ধ্বংস করতে পারে।
ইউক্রেনকে নিজেদের তৈরি ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা আড়াই শ কিলোমিটার পর্যন্ত। রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালাতে এই অস্ত্র ব্যবহারে কিন্তু কখনোই নিষেধাজ্ঞা দেয়নি দেশ দুটি। ফলে স্টর্ম শ্যাডো ব্যবহার করে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর কুরস্ক ও বেলগোরোদে হামলা চালাতে পারে ইউক্রেন।
এখানেও কিছু ঝামেলা আছে। বর্তমানে ইউক্রেনের হাতে থাকা স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দেশটির সু-২৪এস যুদ্ধবিমানে যুক্ত করা আছে। হামলা চালাতে হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধবিমানগুলোকে রুশ সীমান্তের কাছে যেতে হবে। এতে করে সেগুলো রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সহজ নিশানায় পরিণত হতে পারে।
এ ধরনের হামলার জন্য সু-২৪এসের চেয়ে বেশি সক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের। চলতি বছরের শেষের দিকে ইউক্রেন এই যুদ্ধবিমান হাতে পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এফ-১৬ ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরে হামলার চালানোর অনুমতি মিত্রদেশগুলো দেবে কি না, বিষয়টি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কাছে এখনো পরিষ্কার নয়।
এদিকে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালানোর জন্য নিজেরাই অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন বাহিনী। তাদের তৈরি বেশ কিছু ড্রোন এরই মধ্যে সীমান্তের কয়েক শ কিলোমিটার ওপারে রাশিয়ার সামরিক স্থাপনা ও জ্বালানি তেলের ডিপোগুলোয় হামলা চালিয়েছে। সর্বশেষ এমন হামলা হয়েছে রাশিয়ার ওরস্ক শহরের একটি রাডার স্টেশনে। সেটির অবস্থান ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরে।