এখনো রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করছে ইউরোপ–আমেরিকার যেসব প্রতিষ্ঠান

জার্মানিভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি সিমেনস রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মোড়লদের হুমকি–ধমকি আর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গত বছর ইউক্রেনে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর থেকেই মস্কোর ঘাড়ে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। এসব নিষেধাজ্ঞার পরে অনেক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে ইতি টেনেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই আবার বহাল তবিয়তে পুতিনের রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া এমন প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে সাড়ে পাঁচ শতাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য জারি রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ইউরোপের। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার পরেও তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের ২২৩টি স্বাভাবিকভাবে রাশিয়ায় ব্যবসা করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু নামীদামি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যেমন ইতালির জনপ্রিয় ব্র্যান্ড বগি, বেনেত্তন, কালজিদোনিয়া; ফ্রান্সের ক্লারনস ও লাকোসৎ; জার্মানির সিমেনস; আর নেদারল্যান্ডসের ফিলিপস। তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে। বলা চলে, ফ্যাশন হাউস টম ফোর্ড, গৃহস্থালি পণ্যের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড টাপারওয়্যার ও রেস্তোরাঁ টিজিআই ফ্রাইডেসের নাম। এ ছাড়া আলিবাবা ও জেডটিইর মতো অনেকগুলো চীনা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা চালু রেখেছে।

যুদ্ধের পর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অনেক দেশের বিমানবন্দর ও বন্দরে ভিড়তে পারছে না রাশিয়ার উড়োজাহাজ ও জাহাজ। তবে এমিরেটস এয়ারলাইনস, ইজিপ্টএয়ার, কাতার এয়ারলাইনস ও টার্কিশ এয়ারলাইনসের মতো বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আকাশপথে রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্ববাসীর যোগাযোগ রেখে চলেছে।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬২টি কোম্পানি ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ব্যবসা বাড়াবে না, তবে বর্তমান কার্যক্রম চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও শিল্পোন্নত শীর্ষ সাত দেশের জোট জি–৭–এর প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ইতালির প্রতিষ্ঠান বারিল্লা (পাস্তা প্রস্তুতকারী বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান), জার্মানির ফার্মাসিউটিক্যাল ও কৃষিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বাইয়ার এবং ফ্রান্সের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্লা ব্লা কার। এ ছাড়া ইতালির বিলাসবহুল ফ্যাশন পণ্যের ব্র্যান্ড জর্জিও আরমানি, সুইজারল্যান্ডের নেসলে, অস্ট্রিয়ার রেড বুল, যুক্তরাজ্যের ইউনিলিভারসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান এ তালিকায় রয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান সংস্থা এমিরেটস এয়ারলাইনস রাশিয়ায় ফ্লাইট পরিচালনা করছে

ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৭০টি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার সঙ্গে তাদের উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেও কিছু কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডোবি, গুগলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, জনপ্রিয় পানীয় ব্র্যান্ড কোকাকোলা, অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জে পি মরগান। তালিকায় রয়েছে জার্মানির আর্থিক প্রতিষ্ঠান আলিয়েনজ এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তিপণ্য প্রস্তুতকারী বশ। রয়েছে ডেনমার্কের জ্বালানি প্রতিষ্ঠান রাসটেড, সুইডেনের জনপ্রিয় অডিও প্রতিষ্ঠান স্পটিফাই ও জাপানের গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটাও।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ১ হাজার ২০০টির বেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, মাস্টারকার্ড, ভিসা, আইকিয়া ও ম্যাকডোনাল্ডস।

নাম বদলেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান

নামীদামি কিছু পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সুযোগ লুফে নিয়েছেন দেশটির স্থানীয় উদ্যোক্তারা। যেমন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তড়িঘড়ি করে রেস্তোরাঁ বিক্রি করে দেয় ম্যাকডোনাল্ডস। তাদের কাছ থেকে এক রুশ উদ্যোক্তা রেস্তোরাঁগুলো কিনে নেন। এরপর থেকে স্থানীয় নামে সেগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। ম্যাকডোনাল্ডসের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভিকুসনো আই তোচকা’। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় ‘সুস্বাদু এবং কেবল এটুকুই।’

রাশিয়ার বাজারে পশ্চিমা পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো নতুন নামে তাদের ব্যবসা চালু করবে বলেও শোনা যাচ্ছে। এসব ব্র্যান্ড মূলত রাশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য তুরস্ক, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাধ্যমে পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পর্ক কোনো না কোনোভাবে বজায় থাকছে।

রাশিয়ায় এইচঅ্যান্ডএমের একটি বিক্রয়কেন্দ্র

যুদ্ধের পর রুশ অর্থনীতির অবস্থা

যুদ্ধের সময় রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি মস্কোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার অর্থনীতি মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। শুরুর দিকে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেছিলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় রাশিয়ার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের ধারণা ছিল, রাশিয়ার অর্থনীতি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে।

রাশিয়ার অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত থাকার একটি কারণ তাদের জ্বালানি ব্যবসা সচল থাকা। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া রাশিয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। রাশিয়া থেকে ইউরোপের অনেক দেশ জ্বালানির আমদানি কমিয়ে আনার পর চীন ও ভারতের কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি তেল রপ্তানি করে দেশটি। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার তথ্য বলছে, গত বছর প্রতি মাসে রাশিয়ার তেল রপ্তানি বেড়েছে গড়ে ২৪ শতাংশ। যার আর্থিক মূল্য ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গত বছর চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য নতুন এক রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার কোটি ডলার। ২০২১ সালের তুলনায় দুদেশের বাণিজ্য বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

তবে রাশিয়ার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি তেল কিনেছে ভারত। কয়েক মাস ধরে দেশটি থেকে তেল কেনায় রেকর্ড গড়ছে দিল্লি। ভারতের সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারিতে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৪ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে ভারত। ওই মাসে ভারত বিশ্ববাজার থেকে যত তেল কিনেছে, তার ২৮ শতাংশই রাশিয়ার। অথচ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনার পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ২৮ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা দিলেও রাশিয়ার তেলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইউরোপ। আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনে রুশ অভিযানের প্রথম ১০০ দিনে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে ৯ হাজার ৩০০ কোটি ইউরো আয় করেছিল মস্কো। ফিনল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারে (সিআরইএ) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ আয়ের বেশির ভাগই এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ থেকে।