৫২ বছর আগের কথা। ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকাল। যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারের ওয়েস্ট রিডিং শিল্পাঞ্চলের চার কিশোরী তাঁদের প্রথম ছুটির সপ্তাহ একসঙ্গে কাটানোর পরিকল্পনা করেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। মা–বাবাকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে দূরের নৈসর্গিক এলাকা ইংলিশ রিভেরায় চলে যান তাঁরা। পরে ছুটি কাটানোর নানা মুহূর্তে বাঁধা পড়েন একই ফ্রেমে। এরপর সেই ছবি নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
কৈশোরের আনন্দঘন মুহূর্তের এমনই একটি ছবিতে স্বাধীনচেতা ওই কিশোরীদের হাতে হাত বেঁধে, রঙিন পোশাক পরে ইংল্যান্ডের সাগরতীরের অবকাশ শহর টর্কুয়ের রাস্তায় হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় হাঁটতে দেখা যায়।
স্কুলজীবনের ওই সময় কবে পেরিয়ে গেছে। আনন্দের মুহূর্তও রাখা যায়নি আটকে। একে একে কেটে গেছে ৫২ বছর। তবে চার কিশোরীর পাঁচ দশক আগের বন্ধুত্বে আজও ফাটল ধরেনি। বন্ধুত্ব আছে সেই আগের মতোই অক্ষয় ও অমলিন। ৭০ ছুঁই বয়সে এসে গত অক্টোবরে আবারও টর্কুয়েতে ভ্রমণে গিয়েছেন তাঁরা। ধরা পড়েছেন কৈশোরের ছবির মতোই হাতে হাত ধরে, রঙিন পোশাক ও হাস্যোজ্জ্বল চেহারাতে।
সম্প্রতি হ্যালিফ্যাক্স শহর থেকে ৩২২ মাইল যাত্রা করে ডেভন কাউন্টিতে এসেছিলেন কিশোরী থেকে ৭০ ছুঁই নারীতে পরিণত হওয়া এ ৪ জনের ৩ জন। তাঁদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন অন্যজন। সেখানে পাঁচ দশকের বেশি আগের সুখকর স্মৃতিই যেন আবার ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। পোশাক, আড্ডা ও আলাপে প্রতিফলন ঘটান তাঁদের অনেক পুরোনো অথচ অটুট বন্ধুত্বের নিদর্শন।
সম্প্রতি হ্যালিফ্যাক্স শহর থেকে ৩২২ মাইল যাত্রা করে ডেভন কাউন্টিতে এসেছিলেন এই ৪ নারীর ৩ জন। তাঁদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন অন্যজন। সেখানেও পাঁচ দশকের বেশি আগের সুখকর স্মৃতিই যেন তাঁরা নতুন করে ফুটিয়ে তোলেন। পোশাক, আড্ডা ও আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন পুরোনো বন্ধুত্বের বন্ধনে।
যাঁদের বন্ধুত্বের এ কাহিনি, তাঁরা হলেন ম্যারিয়ন ব্যানফোর্থ, সুশান মরিস, মেরি হেলিওয়েল ও ক্যারল অ্যাসব্রো। সপ্তাহব্যাপী ছুটি কাটাতে তাঁরা যখন বাড়ি ছেড়েছিলেন, তখন সবারই বয়স ছিল ১৭ বছর।
স্কুলজীবনের প্রথম সপ্তাহব্যাপী ছুটি কাটানোর স্মৃতিচারণা করছিলেন ম্যারিয়ন ব্যানফোর্থ (৬৯)। বলছিলেন, ওটা ছিল এক দারুণ সময়।
‘আমাদের ওপর কেউ খবরদারি করছে না। কতক্ষণ থাকতে হবে, তা-ও বলছে না। আমরা যা করতে চাইছিলাম, তা-ই করতে পারছিলাম। এ ছিল এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি’, বলেন ম্যারিয়ন।
ম্যারিয়ন আরও বলেন, ‘ছুটির ওই সপ্তাহটিতে আমরা প্রতিদিন টর্কুয়ের সমুদ্রসৈকতে যেতাম। এক ব্যক্তি আমাদের ছবি তুলে দিতেন। বলতেন, ‘‘হাতে হাত বাঁধো’’। তারপর ছবি তুলতেন। আমরাও (চার বন্ধু) বাঁধা পড়তাম এক ফ্রেমে।’
‘আমরা সব সময় একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে আছি। আমরা একে অপরের ভালোমন্দ জানি।’ম্যারিয়ন ব্যানফোর্থ, হ্যালিফ্যাক্স শহরের বাসিন্দা
মা–বাবার চাপমুক্ত ওই সব ছুটির দিনে এ চার বন্ধু আপেল নিংড়ানো রস পান করেছেন, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেছেন আর উপভোগ করেছেন সৈকত–তীরবর্তী শহরের প্রাণচাঞ্চল্যকে।
ছুটির দিনগুলোতে সৈকতের একটি ক্যাম্পে ছিলেন এ চার নারী। সেখানেও ছিল বিনোদনের নানা কিছু।
মেরি হেলিওয়েল (৬৯) এখন অবসরপ্রাপ্ত কাউন্সিল কর্মী। বলছিলেন, ‘সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার কথা আমার খুব মনে পড়ে।’ আরও বলেন, ‘এটা ছিল খোলামেলা একটা সময়।’
স্কুলের ছুটি কাটানোর অর্ধশতকের বেশি সময় পর ম্যারিয়ন, সুশান, মেরি ও ক্যারলের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি এখনো। টর্কুয়েতে আবার ভ্রমণে যাওয়া, একত্রে সময় কাটানো, ছবি তোলার পরিকল্পনা আসে সুশানের ভাবনা থেকে। যদিও এ পরিকল্পনা ঠিকঠাক কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সন্দিহান ছিলেন অপর তিনজন।
অর্ধশতক পর একই স্থানে বেড়াতে যাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করছিলেন সুশান। বলছিলেন, ‘আমরা যখন খাবার খেতে বাইরে যাই, তখন স্কুলের ছুটি কাটানোর একটা ছবি বের করে বলি, এই মেয়েরা, তোমরা কি এমন ছবি আবার তুলতে চাও? সঙ্গে সঙ্গে তারাও রাজি হয়ে যায়।’
যা–ই হোক, ৫২ বছর পর এসে একই স্থানে কৈশোরে তোলা ছবির মতো এক ফ্রেমে বাঁধা পড়া এই চার বন্ধুর জন্য সহজ ছিল না।
একটা সমস্যা ছিল, স্কুলজীবনে যে সাদা রঙের হোটেলকে পেছনে রেখে চার বন্ধু সৈকতে ছবি তুলেছিলেন, তা আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। এতে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে তাঁরা হাতে হাত বেঁধে, হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলেছিলেন, সেটি নিয়ে দ্বিধায় পড়েন।
আবার ৬৯ বছর বয়সে কৈশোরকালের মতো পোশাক পরে ছবি তোলাও ছিল আরেক চ্যালেঞ্জের। ৭০–এর দশকে তাঁরা যে পোশাক পরে ছবি তুলেছিলেন, মূলত তা আনা হয়েছিল ওই সময়ের জনপ্রিয় বিপণী ‘চেলসি গার্ল’ থেকে।
পরে বিভিন্ন দোকান ও সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাকের অনলাইন বাজার ঘুরে চার বন্ধু কৈশোরের আদলে নিজেদের জন্য পোশাক কিনতে সক্ষম হন। অবশ্য সেগুলো গায়ে ঠিকমতো লাগেনি।
মেরি হেসে বলছিলেন, ‘অনলাইন থেকে আমি একটা জামা কিনেছিলাম আর সেটি পরতে আমাকে দুজন সহায়তা করেছিলেন। খানিকটা আঁটসাঁট ছিল ওটা!’
মেরি বলেন, ‘কিন্তু আমরা এমন পোশাক পরেই সৈকতের রাস্তায় যাই। আমরা কী করছিলাম, লোকজন তাকিয়ে দেখছিলেন।’
স্কুলজীবনের প্রথম সপ্তাহব্যাপী ছুটি উদ্যাপনের পাঁচ দশক পর ৪ বন্ধুর এখন ৭ সন্তান ও ১৫ নাতি-নাতনি। এত বছর পরও নিজেদের মধ্যে কৈশোরের বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পেরে গর্বিত তাঁরা।
স্কুলজীবনের প্রথম সপ্তাহব্যাপী ছুটি উদ্যাপনের পাঁচ দশক পর ৪ বন্ধুর এখন ৭ সন্তান ও ১৫ নাতি-নাতনি। এত বছর পরও নিজেদের মধ্যে কৈশোরের বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পেরে গর্বিত তাঁরা।
চার বন্ধুর মধ্যে তিনজন এখনো হ্যালিফ্যাক্সের একটি জায়গায় বসবাস করেন। আর ক্যারল থাকেন স্পেনে। তাঁর জন্মস্থান হ্যালিফ্যাক্সের ক্যালডারডেল বরোতে।
আরও অনেকের মতো এ চার বন্ধুও অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেন। সন্তান, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটানোর মধ্যেও নিয়মিত একে অপরের সংস্পর্শে থাকার চেষ্টা করেন ও খোঁজখবর নেন।
নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন কেমন, তা ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ম্যারিয়ন। বলেন, ‘আমরা সব সময় একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে আছি। আমরা একে অন্যের ভালোমন্দ জানি।’
চার বন্ধুর এমন বন্ধুত্ব নিয়ে গত মাসে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হ্যালিফ্যাক্স কুরিয়ার। এর প্রতিক্রিয়ায় তাঁরা বলেন, তাঁরা বিস্মিত ও অভিভূত।