ইউক্রেনের এলাকা দখলের পর রুশ বাহিনী বিভিন্ন সময় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া ইউক্রেনীয়দের ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের অনেকের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের ইজিয়াম শহরের কাছের একটি গণকবর থেকে চার শতাধিক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়
ইউক্রেনের এলাকা দখলের পর রুশ বাহিনী বিভিন্ন সময় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া ইউক্রেনীয়দের ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের অনেকের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের ইজিয়াম শহরের কাছের একটি গণকবর থেকে চার শতাধিক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়

কেউ কেউ আর ফেরেননি: ইউক্রেনের সাবেক সেনাদের যেভাবে তাড়া করেছে রাশিয়া

ভিক্তর কুশিন জানতেন, রাশিয়ার সেনারা তাঁকে খুঁজছেন। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান চালায় মস্কো। দেশটির খারকিভ অঞ্চলে কুশিনের গ্রাম দখল করে নেয় রুশ বাহিনী। এর পর থেকেই রাশিয়ার হাতে ধরা পড়া নিয়ে শঙ্কা তাঁর মনে দানা বাঁধে।

ওই বছর মে মাসের এক সকালে দুই রুশ সেনা কুশিনকে আটক করেছিলেন। তিনি বাধা দেননি। এরপর কয়েক দিন তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্দী ছিলেন। এই লোকগুলোর সঙ্গে কুশিনের একটা মিল ছিল। পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা।

কুশিনের বয়স এখন ৫৯ বছর। তিনি বললেন, ‘আটকের পর কয়েক দিন ধরে তারা (রুশ সেনা) আমাদের বেধড়ক মারধর করল। তারপর লোহা গরম করে আমাদের শরীরে ছাপ দিয়ে দিল। ছাপটা ছিল ত্রিভুজ আকৃতির। একইভাবে গবাদিপশুর শরীরে ছাপ দেওয়া হয়। তারা এটা করেছিল শুধু প্রতিশোধের জন্য। কারণ, তারা আমাদের ঘৃণা করত।’

কুশিনের মতো এমন অনেক ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে গার্ডিয়ানের। এই লোকগুলো ইউক্রেনের সাবেক সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা। আটকের পর কুশিনের মতো কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় তাঁরা পালিয়ে এসেছেন। অনেকেই খুন হয়েছেন। আর এমন শত শত মানুষের সঙ্গে কী হয়েছে, তা এখনো রহস্যে ঘেরা।

২০১৪ সালের এপ্রিলে দনবাসের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয় দখল করে নেন মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এরপর ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। দুই পক্ষের লড়াইয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। রাশিয়ার দাবি, দনবাসে ইউক্রেনের বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল।

খারকিভের আঞ্চলিক কৌঁসুলির কার্যালয়ের যুদ্ধাপরাধ বিভাগের প্রধান স্পারতাক বোরিশেঙ্কো বলেন, এই মুহূর্তে খারকিভে এক হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে দনবাসের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া ইউক্রেনের শত শত সাবেক সেনা রয়েছেন। আটকের সময় তাঁরা বেসামরিক নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করছিলেন। রুশ বাহিনী খারকিভের বিভিন্ন এলাকা দখলে নেওয়ার পর প্রথমেই তাঁদের আটক করেছিল।

২০১৪ সালের এপ্রিলে দনবাসের বিভিন্ন সরকারি কার্যালয় দখল করে নেন মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এরপর ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। দুই পক্ষের লড়াইয়ে ১০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। রাশিয়ার দাবি, দনবাসে ইউক্রেনের বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান শুরুর একটা কারণ হিসেবে ওই হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছিল মস্কো।  

নির্যাতন করে বলা হতো, ‘এটা উপহার’
গত বছর রুশ বাহিনীর দখলে যাওয়ার পর খারকিভ ও খেরসনের কিছু অঞ্চল মুক্ত করে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এরপর সেখানে পরিদর্শনে যান গার্ডিয়ানের প্রতিবেদকেরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের জানিয়েছেন, দনবাসে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া ইউক্রেনের সাবেক সেনাদের তথ্য রাশিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্থানীয় অনেকে। শুধু তা-ই নয়, রুশ সেনাদের থাকা, খাওয়া, পরিবহন ও জ্বালানি দিয়ে সহায়তাও করেছিলেন তাঁরা।

রুশ সেনারা যখন কুশিনকে আটক করেছিলেন, তখন প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি দনবাসে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন কি না? গার্ডিয়ানকে কুশিন বলেন, ‘আমি লড়াই করেছিলাম। সেটা ২০১৮ সালে। এক বছর ধরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর ৫৩তম ব্রিগেডে গাড়িচালক ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, তারা হয়তো বিষয়টা জানে। তাই লুকানোর কিছু নেই। এরপর তারা আমার বাড়িতে তল্লাশি চালাল। সেখান থেকে আমার উর্দি, মেডেল ও কিছু নথি জব্দ করে নিয়ে গেল।’

কুশিনকে পাঁচ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁর ওপর চলেছিল অকথ্য নির্যাতন। একই পরিণতি হয়েছিল ৪৯ বছর বয়সী আন্দ্রি আনিসিমভের। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দনবাসে ইউক্রেনীয় বাহিনীর একজন সার্জেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। আন্দ্রি আনিসিমভ বলেন, আটকের পর তাঁর পায়ে গরম লোহার ছাপ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটা রাশিয়ার পক্ষে থেকে একটা উপহার।

আটকের পর কুশিনসহ অন্যদের দনবাসের লিমান শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। গত বছরের মে মাসে শহরটি দখল করেছিল রাশিয়া। সেখানেও তাঁদের বন্দিশিবিরে রাখা হয়। অবশ্য লিমানে কুশিনসহ অন্যদের একটা বিশেষ কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল রাশিয়ার হয়ে পরিখা খনন।

দনবাসে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া ইউক্রেনীয়দের শুধু খারকিভ থেকেই আটক করেননি রুশ সেনারা। উত্তর কিয়েভ ও খেরসনের মতো অনেক অঞ্চলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। স্পারতাক বোরিশেঙ্কো বলেন, ‘এই লোকগুলোকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখেছেন, এমন অনেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা গুলির শব্দ শুনেছেন, আটক লোকজনের ওপর নির্যাতনের সময় তাঁদের চিৎকার শুনেছেন। তাঁদের অনেকেই ফিরে আসেননি।’  

শত শত কবরের সন্ধান
গত সেপ্টেম্বরে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের ইজিয়াম শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি জঙ্গলে শত শত কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। রাশিয়ার কাছ থেকে এর আগে শহরটি দখলমুক্ত করেছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই কবরগুলো থেকে ৪৪০টির বেশি পচা-গলা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহগুলোর অন্তত ১০টি ছিল দনবাসের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সাবেক সেনাদের। তাঁদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল।

গত বছরের আগস্টে ইউলিয়া পুহাচ নামের এক ইউক্রেনীয়ের ভাইকে রুশ সেনারা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর নাম ডেনিস লালকা। দনবাসের লড়াইয়ে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। ইউলিয়া পুহাচ বলেন, ‘ভাইকে এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেছিলাম আমরা। কারণ, আমরা জানতাম তিনি রাশিয়ার নিশানায় রয়েছেন। তবে ভাই বলেছিলেন, তিনি বন্ধুদের ছেড়ে যাবেন না। এরপর তিনি কেমন আছেন, তা জানতে প্রতিদিন তাঁকে খুদে বার্তা পাঠাতাম। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট তাঁর কাছ থেকে ফিরতি বার্তা পেয়েছিলাম।’  

দনবাসে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সাবেক সেনা আন্দ্রি আনিসিমভ বলেন, তাঁদের আটকের পর ইউক্রেনের উর্দি পরতে বাধ্য করা হয়েছে, যেন তাঁদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে দেখানো যায়। অনেক ক্ষেত্রে আবার তাঁদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগ এনে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।  

গত সেপ্টেম্বরে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের ইজিয়াম শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি জঙ্গলে শত শত কবরের সন্ধান পাওয়া যায়। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই কবরগুলো থেকে ৪৪০টির বেশি পচা-গলা মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিলেন ইউলিয়া পুহাচও। তিনি বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় ক্রিমিয়া থেকে একটি ফোনকল পেলাম। একজন বললেন, তিনি আইনজীবী। আর আামার ভাইয়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতির অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁর বিচার চলছে। আমি বললাম, আমি তাঁকে দেখতে যেতে চাই। তিনি বললেন, “কষ্ট করার দরকার নেই। সব বন্দীকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”’

রাশিয়ায় নিয়ে চলছে বিচার
দনবাসের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সাবেক সেনা ও ইউক্রেনের বেসামরিক লোকজনকে আটকে রাখা হয়েছিল, এমন কয়েকটি স্থান শনাক্ত করেছে ইউক্রেনের গোয়েন্দা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা। স্থানগুলো ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা বিভিন্ন অঞ্চল ও রাশিয়ায় অবস্থিত।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এমন একটি সংস্থা মিডিয়া ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান রাইটস। ইউক্রেনের এ সংস্থাটির কর্মকর্তা আনাস্তাসিয়া পেন্তালাইয়েভা বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, তাঁদের হয়তো ক্রিমিয়ার সিমফেরোপোলে, খেরসনের চোনগার গ্রামে এবং খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার বিভিন্ন পুলিশ কার্যালয় ও প্রশাসনিক ভবনে আটকে রাখা হয়েছিল।’

ইউক্রেনের কর্মকর্তারা মনে করেন, এই বন্দীদের অনেককে মস্কোর ১২০ কিলোমিটার দূরে তুলা শহরের একটি কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে থাকা অনেকের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। মস্কোয় তাঁদের বিচার চলছে।

গত সেপ্টেম্বর থেকে স্বামীর খোঁজ পাচ্ছেন না খারকিভের তাভিলঝাঙ্কা গ্রামের প্রধান ভিতলানা মোরোজ। তাঁর স্বামী ইউক্রেনের সাবেক সেনা ছিলেন না। তবে জানা গেছে, রুশ বাহিনীর হাতে আটকের সময় দনবাসের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সাবেক এক সেনার সঙ্গে ছিলেন তিনি। ওই সেনারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

ভিতলানা মোরোজও একসময় রুশ বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন। তিনি খারকিভের কুপিয়ানস্ক শহরে একটি কারাগারে বন্দী ছিলেন। রুশ সেনাদের হত্যার হুমকি পেয়ে তিনি কোনোমতে নিজ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘(স্বামীর সন্ধানে) আমি ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এ নিয়ে রেডক্রসের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, তিনি বেঁচে আছেন।’

প্রথমে যাঁর কথা বলা হয়েছিল, সেই ভিক্তর কুশিন তিন মাসের বেশি রাশিয়ার হাতে বন্দী থাকার পর মুক্তি পেয়েছিলেন। বন্দী থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, তাঁর বাবা অসুস্থ। বাবাকে সেবা করার জন্য রুশ সেনা কর্মকর্তাদের কাছে নিজ গ্রামে ফেরার অনুমতি চেয়েছিলেন তিনি।

কুশিন বলেন, ‘আমাদের যেখানে বন্দী করা হয়েছিল, সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা রুশ মেজর বাবার অসুস্থতার কথা শুনে আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে আমার মনে হয়, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ, দনবাসে আমি একজন সাধারণ গাড়িচালক ছিলাম। রক্তপাতের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। অন্য বন্দীদের অনেকে লিমান শহরে ইউক্রেনীয় সেনাদের হামলার সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর বাকিরা, একেবারে যেন উধাও হয়ে গেছেন।’


সংক্ষেপিত অনুবাদ: শেখ নিয়ামত উল্লাহ