আল-জাজিরার প্রতিবেদন

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে চুপ কেন রামাফোসার দক্ষিণ আফ্রিকা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনে তোলা
ছবি: রয়টার্স

আগামী মাসে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ‘মোশি’ (দক্ষিণ আফ্রিকার তাসওয়ানা ভাষায় শব্দটির অর্থ ধোঁয়া) নামের এই মহড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার ৩৫০ সেনার অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন এমন একটি যৌথ মহড়ায় প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার অংশগ্রহণে মোটেও খুশি নয় ওয়াশিংটন।

দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে আগামী ১৭ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিদেশীয় এই সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। একই সময়ে ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করা হবে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করেছিল মস্কো। আল জাজিরা

‘বিশ্বে সব দেশই বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। এ জন্য কোনো দেশের ওপর বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মহড়ায় অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এ থেকে আমার দেশকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না।’
নালেদি পানদোর, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে ত্রিদেশীয় সামরিক মহড়া নিয়ে সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জ্যঁ-পিয়েরে বলেছেন, ইউক্রেনে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো দেশের সামরিক মহড়ায় অংশ নেওয়ার ঘটনায় ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন।

এমন এক সময় হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এই উদ্বেগ জানানো হয়েছে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী প্রিটোরিয়ায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পানদোরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। এই বৈঠকের পর দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে সামরিক মহড়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয়।

‘স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে তিন দেশ। এটা নিয়ে কোনো লুকাছাপা করা হচ্ছে না। এই মহড়া নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বেগ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।’
সের্গেই লাভরভ, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

পরে নালেদি পানদোর সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বে সব দেশই বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। এ জন্য কোনো দেশের ওপর বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মহড়ায় অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এ থেকে আমার দেশকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না।’

আর যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে লাভরভ বলেছেন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে যাচ্ছে তিন দেশ। এটা নিয়ে কোনো লুকাছাপা করা হচ্ছে না। এই মহড়া নিয়ে অন্য কোনো দেশের উদ্বেগ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।

গত মার্চে রাশিয়ার বিপক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। তাতে ইউক্রেনে হামলার জন্য মস্কোর সমালোচনা করার পাশাপাশি দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছিল। ওই প্রস্তাব পাসের জন্য যখন ভোটাভুটি হয়, তখন ভোটদানে বিরত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এ ছাড়া গত অক্টোবরে ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে প্রণীত একটি প্রস্তাবনা পাস করাতে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়েছিল। ওই সময় ভোটদানে বিরত ছিল ৩৪টি দেশ। এই ৩৪ দেশের একটি দক্ষিণ আফ্রিকা।

লাভরভের এই সফরকে ‘সাধারণ একটি সফর’ চিহ্নিত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। তবে লাভরভের এই সফরকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরোধী দল ও দেশটিতে অবস্থানরত ইউক্রেনীয়দের জন্য সংবেদনশীল বিবেচনা করা হচ্ছে। এমনকি লাভরভের প্রিটোরিয়া সফরের ঠিক এক দিন পরই মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় সফরে গেছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভেতরে–বাইরে লাভরভের এই সফর কেন এত গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বুঝতে হলে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে প্রিটোরিয়ার অবস্থান এবং রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দিকে তাকাতে হবে।

‘আমরা ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের সরকারের কোনোভাবেই রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন দেওয়া উচিত হবে না।’
জন স্টেনহুইসেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরোধী নেতা।

যুদ্ধ নিয়ে ‘নিরপেক্ষতা’

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বরাবরই বলে এসেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তারা কোনো বিশেষ পক্ষে নেই। বরং এ বিষয়ে তাদের নীতি নিরপেক্ষ।

তবে গত মার্চে রাশিয়ার বিপক্ষে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। তাতে ইউক্রেনে হামলার জন্য মস্কোর সমালোচনা করার পাশাপাশি দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রস্তাব পাসের জন্য যখন ভোটাভুটি হয়, তখন ভোটদানে বিরত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

এ ছাড়া গত অক্টোবরে ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে প্রণীত একটি প্রস্তাবনা পাস করাতে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়েছিল। তখন ভোটদানে বিরত ছিল ৩৪টি দেশ। এই ৩৪ দেশের একটি দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রিটোরিয়ায় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর নালেদি পানদোর বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বাস করে, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় কূটনৈতিক আলোচনা। শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সনদের আওতায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে খোলামনে আলোচনায় বসতে হবে।

কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর জন্য পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে দায়ী করেছেন। গত মার্চে তিনি বলেছিলেন, ন্যাটোর পূর্বমুখী নীতি ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যতম কারণ। বছরের পর বছর ধরে এই সামরিক জোটের নেতা ও কমকর্তারাই বারবার সতর্ক করেছিলেন, এই নীতি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। কিন্তু এসব সতর্কবার্তা আমলে নেওয়া হয়নি।

এসবের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার দাবি, ইউক্রেন ইস্যুতে তারা ‘নিরপেক্ষ’ নীতি মেনে চলছে।

‘নিরপেক্ষতা’র কারণ কী

দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। বর্ণবাদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যখন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাসীন দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) লড়াই করছিল, তখন থেকেই মস্কোর সঙ্গে বন্দুত্ব দলটির–দেশটির।

এমনকি এএনসির অনেক নেতাই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার উদার হওয়ার সংগ্রামে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন সোভিয়েত নেতারা। অন্যদিকে পশ্চিমাদের অবস্থান ছিল ঠিক উল্টো। এএনসিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল ওয়াশিংটন। এমনকি ২০০৮ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ছিলেন একজন ‘সন্ত্রাসী’।

দক্ষিণ আফ্রিকা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য। স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশ এই জোট গঠন করে ঘোষণা দেয়, তারা মার্কিন–সোভিয়েত কোনো বলয়কেই সমর্থন দেবে না, নিরপেক্ষ থাকবে। তখন থেকে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর আগপর্যন্ত দক্ষিণ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তি ছিল এই নিরপেক্ষতা।
তবে যেকোনো সংকট নিরসনে দেশটি বরাবর আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন সময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সংকট ও সংঘাত নিরসনে আলোচনার আয়োজন করেছে প্রিটোরিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে তাইগ্রে অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে ইথিওপিয়া সরকার ও দেশটির বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি আলোচনার আয়োজন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

এসব ঘটনা ও নীতির আলোকে ইউক্রেন নিয়েও নিরপেক্ষ থাকতে চাইছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই দেশটির মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা কখনোই কোনো পক্ষের হয়ে কথা বলেন না।

আরও যেসব নির্ভরতা

দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়া—উভয়ই অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের সদস্য। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার এই জোট পরস্পরের সঙ্গে নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০২০ সালে দেশটি রাশিয়ায় প্রায় ৫৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে একই বছরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যমানের পণ্য রপ্তানি করেছে রাশিয়া।

সমালোচনার মুখে সরকার

তিন দেশের সামরিক মহড়ায় যুক্ত হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সমালোচনা করেছে জেসমন্ড টুটু ফাউন্ডেশন। দেশটির প্রয়াত আর্চবিশপ ও নোবেলজয়ী জেসন্ড টুটুর প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান গত সপ্তাহে বলেছে, ‘সামরিক মহড়ায় অংশ নেওয়ার এই উদ্যোগ দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অমর্যাদাকর। দক্ষিণ আফ্রিকা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে, এমন ঘোষণার সমান।’

দেশটির প্রধান বিরোধী জোট ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সমালোচনা করে বলেছে, সামরিক মহড়ায় যোগ দেওয়ার এই উদ্যোগ দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরিয়ে আনছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সবসময় নিপীড়িতের পক্ষে কথা বলেছে। তাই নীতির পরিবর্তন ঘটালে সরকারের কিয়েভের পাশে থাকা উচিত।

পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে গত মার্চে বিরোধী নেতা জন স্টেনহুইসেন বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। আমাদের সরকারের কোনোভাবেই রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন দেওয়া উচিত হবে না।’ তাঁর মতে, সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের ও বিশেষত অর্থনীতির স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।