পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি। সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মধ্য বামপন্থী দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার। এর মধ্য দিয়ে ২০১০ সাল থেকে একটানা শাসনক্ষমতায় থাকার পর সরে দাঁড়াতে হলো রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টিকে।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমনসের ৬৫০ আসনে গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন হয়। লেবার পার্টির জয়ের যে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, তার ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায়নি আজ শুক্রবার প্রকাশিত ফলে। ঘোষিত ফলে নিম্নকক্ষের ৪১২ আসনে জয় পেয়েছে দলটি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের চেয়ে ২১৪ আসন বেশি পেয়েছে তারা। অন্যদিকে কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১ আসন, যা গতবারের চেয়ে ২৫১টি কম।
লেবার পার্টির বিজয়ের পরপরই বাকিংহাম প্রাসাদে ডাক পান কিয়ার স্টারমার। সেখানে রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁকে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর আগে বিজয় ভাষণে স্টারমার বলেন, ‘পরিবর্তনের শুরু হলো। আমরা বলেছিলাম, বিশৃঙ্খলায় ইতি টানব। সেটা করে দেখাব আমরা। আজ থেকে (যুক্তরাজ্যে) নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।’
স্টারমারের এই ‘নতুন অধ্যায়ের’ সঙ্গী হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চার ব্রিটিশ নারীও। লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত এই চারজন হলেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রূপা হক ও আপসানা বেগম। নির্বাচনে বিভিন্ন দল থেকে ও স্বতন্ত্র হিসেবে মোট ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
এবারের নির্বাচনে লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টির বাইরে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৯৬টি দল অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে বেশ ভালো করেছে লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টি। হাউস অব কমনসে ৭১টি আসন পেয়েছে তারা, যা আগেরবারের চেয়ে ৬৩টি বেশি। অপর দিকে গতবারের তুলনায় ৩৮টি আসন হারিয়েছে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। এর মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ডে এক দশকের আধিপত্য হারাল তারা।
নির্বাচন শেষে এখন ৯ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথ গ্রহণ ও স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৭ জুলাই রাজা চার্লসের উদ্বোধনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করবে নতুন সরকার।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর কনজারভেটিভ পার্টির দলনেতার পদ ছেড়েছেন ঋষি সুনাক। লেবার পার্টির নেতা স্টারমার রাজার কাছে যাওয়ার আগেই বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে সরকারপ্রধানের পদ ছাড়েন সদ্য সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে দেওয়া এক ভাষণে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান তিনি।
দলের এই বিপর্যয়ের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে সুনাক বলেন, ‘আমার সবটুকু দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি। তবে আপনারা পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন যে যুক্তরাজ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন। আপনারা যে রায় দেবেন, সেটিই শিরোধার্য। আমি আপনাদের ক্ষোভ ও হতাশা দেখেছি। এই পরাজয়ের দায় আমি নিজের কাঁধে নিলাম।’
গত ২ মে যুক্তরাজ্যের স্থানীয় নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির হতাশাজনক ফলের পর ২২ মে হঠাৎ আগাম জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন সুনাক। ব্রেক্সিট-পরবর্তী নড়বড়ে অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যাসহ সম্প্রতি অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দলটির ওপর বেশ বিরক্ত ছিল জনগণ। কনজারভেটিভ নেতৃত্বের প্রতিও আস্থা রাখতে পারছিল না মানুষ।
২০১৯ সালের নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল লেবার পার্টি। সেবার ৮৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল দলটি। এরপর মধ্য বাম দলটির টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। তবে এবারের নির্বাচনে সাফল্যের পর যেন ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা।
লেবারদের জয়ের পরপরই ব্রিটিশ পাউন্ড, সরকারি বন্ড ও শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এমন এক সময় স্টারমার যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় এলেন, যখন নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত দেশটির মানুষ। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখন ব্রিটিশ নাগরিকদের কাঁধে সবচেয়ে বেশি করের বোঝা চেপেছে। দেশটির ঋণের পরিমাণও উদ্বেগজনক। কমছে জীবনযাত্রার মান। আর জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার মতো বেশ কিছু সরকারি সেবাব্যবস্থা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে।
এসব সমস্যা সমাধানে এরই মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন স্টারমার। শ্রমজীবী মানুষের জন্য কর না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে কনজারভেটিভরা যে বিতর্কিত নীতি হাতে নিয়েছিল, তা-ও বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করা এই অভিবাসীদের ঠেকাতে বড় চাপের মধ্যে পড়বেন তিনি।
সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে স্টারমার বলেছেন, ‘কাজগুলো যে সহজ হবে, তা আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দেব না। কোনো দেশকে পরিবর্তন করা সুইচ টেপার মতো বিষয় নয়। এটা কঠিন কাজ। এর জন্য ধৈর্য, দৃঢ়সংকল্প ও পরিশ্রমের প্রয়োজন। আমাদের এখন দ্রুত কাজ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’