যুদ্ধে সমাপ্তি টানা মোটেও সহজ কাজ নয়। এমনকি যুদ্ধবিরতির জন্য একটি সমঝোতায় পৌঁছানোটাও জটিল। সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পর সর্বোচ্চ ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সই করেছে ইউক্রেন। তবে এরপর যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তাতে এই যুদ্ধবিরতি কীভাবে কার্যকর করা হবে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
মস্কো ও কিয়েভে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক অ্যাটাচে জন ফোরম্যান বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি যদি ৩০ দিনের জন্য হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো তা মেনে চলা হচ্ছে কি না? এর আগে রাশিয়ার শান্তিচুক্তি বা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভাঙার রেকর্ড রয়েছে, তাই বর্তমানে এমন কোনো চুক্তি কার্যকরের জন্য শক্তিশালী একটি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ইতিহাসের কাছে চ্যালেঞ্জটি আরও জোরলো হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মিনস্ক চুক্তির অংশ হিসেবে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো–অপরেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) একটি মিশনের আওতায় প্রায় এক হাজার জন কয়েকটি গাড়িতে করে ইউক্রেনে টহল দিতেন। তাঁদের দায়িত্ব ছিল ইউক্রেনের পূর্ব দনবাস অঞ্চলের দুই পক্ষের সহিংসতা বন্ধের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা।
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য এশিয়ার ৫৭টি দেশ নিয়ে ওএসসিই গঠিত। পূর্ব দনবাসে পর্যবক্ষণের জন্য এই সংস্থাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই দেশই এর সদস্য। তবে দনবাসে উত্তেজনা কমাতে হিমশিম খেয়েছে ওএসসিই। ২০১৭ সালে সেখানে ৪৮৬ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৪ লাখ বার যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছিল। ২০২১ সালে মৃত্যু কমে ৯১ জনে এবং যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের সংখ্যা কমে ৯৩ হাজার ৯০২–এ দাঁড়িয়েছিল। এর মাত্র দুই মাস পর ইউক্রেনে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক এবং ওএসসিইর ইউক্রেন মিশনের সাবেক পর্যবেক্ষক সামির পুরি বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে ওএসসিইর কাজ অনেক ব্যাপক। ২০১৫ সালে ওএসসিই মূলত দনবাসের তুলনামূলক ছোট যুদ্ধক্ষেত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করত। সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে হতো ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে। যুদ্ধক্ষেত্র এখন অনেক বড় হয়েছে। দুই দেশের সামরিক বাহিনী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে সেখানে মোতায়েন রয়েছে।
ড্রোন, উড়োজাহাজ ও স্যাটেলাইটের মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর কারণে ২০২৫ সালে এসে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করাটা আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। স্মৃতিচারণা করে সামির পুরি বলেন, এক দশক আগে এই কাজের জন্য ওএসসিই মিশনের কাছে মাত্র চারটি ড্রোন ছিল। রাশিয়া–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাঝেমধ্যে ওই ড্রোনগুলোয় গুলি করে নিজেদের নিশানা পরীক্ষা করতেন। যদিও ওই ড্রোনগুলোর কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে ওএসসিইর কম পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন পড়ত, তবে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করা হলে ড্রোনগুলো কোনো সাহায্য করতে পারত না।
বৃহস্পতিবার এই বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মস্কোয় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যুদ্ধের সম্মুখসারি যখন ২ হাজার কিলোমিটার, তখন এই যুদ্ধবিরতি কে নিয়ন্ত্রণ করবে? এর জন্য কয়েক হাজার পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন পড়বে। একই সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ এবং যুদ্ধক্ষেত্র সংঘাতমুক্ত রাখার সক্ষমতা থাকতে হবে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে ইউরোপের দেশগুলো একটি বাহিনী সৃষ্টির কথা বলেছে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তির ক্ষেত্রে বাহিনীটি ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে এই বাহিনীর সংগঠকেরা বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তি বজায় রাখা এই বাহিনীর কাজ হবে না। এই সংগঠকদের একজন বলেন, তাঁরা শান্তিরক্ষী নন। বাহিনীটি শুধু ইউক্রেনের আকাশসীমা, সমুদ্র উপকূল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় কাজ করবে।
এর পরও দুই পক্ষকে সংযত করতে এবং তাদের মধ্যে আস্থা গড়ে তুলতে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন মস্কো ও কিয়েভে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক অ্যাটাচে জন ফোরম্যান। তিনি বলেন, সমস্যা হলো মিনস্ক চুক্তির পর যা ঘটেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ নিয়ে ইউক্রেনের ধারণা ভালো নয়। আর দুর্বলভাবে কার্যকর করা যুদ্ধবিরতির কারণে লড়াই আবার নতুন করে শুরু হতে পারে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে নতুন করে ওএসসিইর দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সংস্থাটি ২০১৪ সালে ইউক্রেনে যে মিশন শুরু করেছিল, তা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার হামলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়। হামলার পরপরই ইউক্রেন থেকে ওএসসিই তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়।
ইউক্রেনে নতুন করে যুদ্ধবিরতি হলে তা পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কেউ দায়িত্ব পেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ–সংক্রান্ত প্রস্তাবে রাশিয়ার সায় থাকতে হবে।
সামির পুরি মনে করেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকরে আরেকটি বাস্তবসম্মত উপায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারির দুই পাশেই বেসামরিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। সেখানে ইউক্রেনের মতো রাশিয়ারও নিজস্ব বিশেষ বাহিনী থাকবে। ওই বাহিনী চীনের মতো মস্কোর বিভিন্ন মিত্রদেশের সেনাসদস্যদের নিয়ে গঠন করা হবে। তাদের ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগের সক্ষমতা থাকতে হবে।
শেষ পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তি তখনই সম্ভব হবে, যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষ হামলা চালিয়ে বা উসকানি দিয়ে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘনের চেষ্টা না করে। কোরিয়া ও সাইপ্রাসের মতো কিছু যুদ্ধবিরতি টিকে গেছে; কারণ, এসব ক্ষেত্রে কোনো পক্ষই যুদ্ধ নতুন করে শুরু করতে চায়নি। তবে ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার শত্রুতার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আর অনেকে মনে করেন, প্রতিবেশী দেশে পুতিনের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য অপরিবর্তিত থাকবে।
এমন পটভূমি সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত এটা পরিষ্কার নয় যে—যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির সময় সহিংসতা ঠেকানোর জন্য কীভাবে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। জন ফোরম্যান বলেন, ‘শান্তিতে পৌঁছানোর আগে অনেক অনেক বাধা আসবে। সেগুলো আমাদের সামলাতে হবে।’