মধ্য এশিয়ায়ও কি বন্ধু হারাচ্ছেন পুতিন

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ নতুনভাবে কষতে হচ্ছে রাশিয়াকে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ নতুনভাবে কষতে হচ্ছে রাশিয়াকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়ে মস্কোকে একঘরে করতে চাইছে। অনেক দেশ আবার ইউক্রেনে রুশ অভিযানের পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। এরই মধ্যে ইউক্রেনে মস্কো নিয়ন্ত্রিত চার অঞ্চলে গণভোট ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘আংশিক সেনা নিযুক্তির’ ঘোষণা এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের ভাষ্য, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছে মস্কোর। ওই দেশগুলোকে মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ধরা হয়।  

মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর একটি কাজাখস্তান। পুতিনের আংশিক সেনা নিযুক্তির ঘোষণার পর যুদ্ধে অংশ নেওয়া এড়াতে দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন রাশিয়ার অনেক নাগরিক। কাজাখস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ২১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে প্রবেশ করেছেন রাশিয়ার প্রায় এক লাখ নাগরিক। এর জন্য মস্কোকেই এক প্রকার দায়ী করে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ গত মঙ্গলবার বলেছেন, রাশিয়ার বেশির ভাগ নাগরিক দেশ ছাড়ছেন সেখানকার চলমান পরিস্থিতিতে নিরাশ হয়ে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট তোকায়েভের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থামাতে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) কয়েক শ সেনা দেশটিতে পাঠিয়েছিল ক্রেমলিন। তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব বেশ স্পষ্ট।

কাজাখস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত সোমবার জানানো হয়েছে, ইউক্রেনে ক্রেমলিনের আয়োজন করা গণভোটের স্বীকৃতি দেবে না তারা। গত শুক্রবার থেকে পাঁচ দিন ধরে ইউক্রেনের খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া, লুহানস্ক ও দোনেৎস্কে এই ভোট হয়। ভোটে অঞ্চলগুলো রাশিয়ায় যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এক ঘরে করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো

গত জুনেও কাজাখস্তানের পক্ষ থেকে একই প্রতিক্রিয়া এসেছিল। তখন প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ পুতিনকে বলেছিলেন, ইউক্রেনের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলকে মস্কো যে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে, তার সমর্থন জানাবে না কাজাখস্তান।

রাশিয়ার অনেক নাগরিক গেছেন কাজাখস্তানের প্রতিবেশী উজবেকিস্তানেও। পুতিনের নেওয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ বা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে কাজাখস্তানের চেয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে দেশটির সরকার। উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সাভকাত মিরজিওইয়েভ এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ অভিযানে সমর্থন বা নিন্দা—কোনোটাই জানাননি। তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ কোমিলভকে বরখাস্ত করেছেন তিনি। গত মার্চে কোমিলভ বলেছিলেন, ইউক্রেনে মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোর স্বীকৃতি দেবে না তাশখন্দ। অবশ্য মধ্য এশিয়ার কোনো দেশই এখনো স্বঘোষিত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পথে হাঁটেনি।

এ নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিউ ডিলিজেন্স সেন্ট্রাল এশিয়ার পরিচালক আলিশের ইলখামভ বলেন, এখন পর্যন্ত তাশখন্দ নীরব রয়েছে। মনে হচ্ছে, মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় পাচ্ছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।

রাশিয়ায় অনেক উজবেক নাগরিক কাজ করেন। এরপরও উজবেক নাগরিকদের যুদ্ধে যোগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ২৩ সেপ্টেম্বর একটি আদেশ জারি করে দেশটির সরকার। এটাও মস্কোর প্রতি সম্পর্কের দূরত্বের ইঙ্গিত দেয়।

শুধু উজবেকিস্তানই নয়, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা অনেক দেশের নাগরিকেরাই রাশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মাঝেমধ্যে তাঁদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালায় মস্কো। ফেরত পাঠানো হয় নিজ দেশে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, দেশগুলোর সরকারকে চাপে রাখতে ক্রেমলিনের কৌশল এটি।
এদিকে বেশ কয়েক বছর ধরে তুর্কমেনিস্তান মস্কোর রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে।

রাশিয়ার সঙ্গে নিজেদের সীমান্তও বন্ধ রেখেছে তারা। মধ্য এশিয়ার বাকি দুই দেশ তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবশ্য মস্কোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য রয়েছে। তবে তারাও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সমর্থন বা সমালোচনা—কোনোটাই করেনি। রাশিয়া সরকার বিরোধিতা করলেও দেশটি ছেড়ে আসা লোকজন এই দুই দেশেও আশ্রয় নিচ্ছেন।

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভিন্নমতাবলম্বী অনেক রুশ নাগরিককে আশ্রয় দিচ্ছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো। তবে এর ফলে মস্কো ও এই অঞ্চলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, তা অনুমান করা কঠিন বলে মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। রুশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি পলিটিকার বিশেষজ্ঞ তেমুর উমারভের মতে, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও অনুমান করা জটিল।

আল-জাজিরাকে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রুশ নাগরিকেরা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয় আসায় মনে হচ্ছে যে সেখানে স্বল্প মেয়াদে নির্দিষ্ট কিছু আর্থিক সূচক বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে তারা বোঝা হয়েই দাঁড়াবে। কারণ, এটা এখনো নিশ্চিত না, কীভাবে তারা এই দেশগুলোতে খাপ খাইয়ে নেবে, আর কীভাবেই অন্যের সাহায্য ছাড়া চাকরি খুঁজে পাবে।