তিন দিক থেকে রুশ বাহিনী যেভাবে হামলা শুরু করে, তাতে কিয়েভের পতন সময়ের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এ হামলা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার ৪০ মাইল দীর্ঘ সমরযানের বহরের স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশিত হয়। তাতে ইউক্রেন তো বটেই, তার পশ্চিমা মিত্ররাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। তবে ইউক্রেনের তীব্র প্রতিরোধে একসময় এ বহর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হয়ে রাশিয়া তার যুদ্ধকৌশল বদলাতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে তারা ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের দিকে নজর দেয়। কিন্তু যুদ্ধের এক বছরেও বিশেষ সামরিক অভিযানের ইতি টানতে পারেনি মস্কো।
গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া। এসব অঞ্চলের আয়তন ইউক্রেনের মোট ভূমির প্রায় ১৫ শতাংশ। এ দখলকে বৈধতা দিতে অঞ্চল চারটিতে কথিত গণভোটের আয়োজন করেছিল মস্কো। কিন্তু ওই গণভোটকে কিয়েভসহ পশ্চিমারা স্বীকৃতি দেয়নি।
ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো রাশিয়া দখল করে নিলেও তা ধরে রাখা নিয়ে পরবর্তী সময়ে মস্কোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। পশ্চিমা মিত্রদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেন। দখলকৃত এলাকার পাশাপাশি রাশিয়ার ভেতরের লক্ষ্যবস্তুতেও তারা হামলা চালিয়ে মস্কোকে হতবাক করে দেয়।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি খেরসন অঞ্চলের রাজধানী খেরসন শহর পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেন। তারা দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনের অংশবিশেষ থেকে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোকে চাপে ফেলে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে কিয়েভ দাবি করে, রাশিয়ার দখল থেকে প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা রুশ বাহিনীর দখলে আছে।
তবে গত দু-এক মাসের পরিস্থিতি বলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো পক্ষই বড় কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। ইউক্রেনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে দেশটির বিভিন্ন শহরের বিদ্যুৎসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া।
রুশ হামলা প্রতিরোধে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ট্যাংকসহ অন্যান্য সমরাস্ত্রের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ইউক্রেন। এগুলো দ্রুত কিয়েভকে সরবরাহ করতে আহ্বান জানাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
সম্প্রতি জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনকে দ্রুত অস্ত্র দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। পশ্চিমাদের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিমানও চাইছেন জেলেনস্কি। কিন্তু কিয়েভকে যুদ্ধবিমান দেওয়া নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ইউক্রেনে প্রাণহানি বাড়ছে বলে একাধিকবার হতাশা প্রকাশ করেছেন জেলেনস্কি।
নরওয়ের সর্বশেষ হিসাবমতে, এক বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের ১ লাখ সেনা নিহত বা আহত হয়েছেন। হতাহত রুশ সেনাদের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার। অবশ্য অন্যান্য পশ্চিমা সূত্রের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের ১ লাখ ৫০ হাজার করে সেনা হতাহত হয়েছেন। এ ছাড়া এ যুদ্ধে ইউক্রেনের ৩০ থেকে ৪০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া হামলা জোরদার করতে পারে বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল ইউক্রেন। সম্প্রতি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব ইয়ানেস স্টলটেনবার্গ বলেন, আশঙ্কা অনুযায়ী রাশিয়ার বসন্তকালীন জোর হামলা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ইউক্রেন বলছে, তারা আগামী সপ্তাহগুলোয় পাল্টা হামলা জোরদার করবে।
চলমান যুদ্ধে কারও পূর্ণ সামরিক বিজয় অর্জন করা নিয়ে সন্দিহান সমরবিশ্লেষকেরা। এই যেমন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলে অকপটে বলেছেন, যুদ্ধে কেউ জিতবে না। যুদ্ধ বন্ধের একমাত্র কৌশল হতে পারে কূটনৈতিক উপায়ে শান্তি চুক্তি করা।
কিন্তু যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত ক্ষীণ, যা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে দিন কয়েক আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য পশ্চিমারা প্রস্তুত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যুদ্ধ যে সহজে থামছে না, তার সব আলামত এখন স্পষ্ট। গত মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য নেশন’ ভাষণে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক ঘণ্টার মাথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া কখনোই জয়ী হবে না।
দুজন বিশ্লেষকের কথায় সংকটের স্বরূপ বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিখাইল অ্যালেক্সিভের মতে, মস্কোর কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে কিয়েভ কোনো সমঝোতায় যেতে চাইবে না। কারণ, বিষয়টির সঙ্গে কিয়েভের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে পুতিন কোনো সমঝোতায় যাবেন না বলে মনে করেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের ইতিহাসের অধ্যাপক ভ্লাদিস্লাভ জুবোক। তাঁর মতে, দখলকৃত ভূমি ছেড়ে সমঝোতার রাজনৈতিক মূল্য পুতিন বহন করতে পারবেন না।
তাহলে এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী? যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আরএএনডি করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্যামুয়েল চার্প বলেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার বৈরিতায় এ সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে।’
তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, এনপিআর, বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স।