জার্মানির ঐক্যের ৩৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসব ছিল ৩ অক্টোবর। এবার জার্মান পুনরেকত্রীকরণ উৎসব পালিত হয়েছে এলব নদীতীরে বন্দর শহরে হামবুর্গে। জার্মান ঐক্যের ৩৩ বছর স্মরণে এবারের স্লোগান ছিল, ‘ভবিষ্যতের জন্য উন্মুক্ত দিগন্ত’।
কিন্তু মাত্র ৫ দিন পরই দেখা গেল, জার্মানিতে ‘ভবিষ্যতের জন্য উন্মুক্ত দিগন্ত’ ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। ৮ অক্টোবর ছিল জার্মানির দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হেসেন ও ব্যাভেরিয়ার রাজ্য সংসদের নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে কট্টরবাদীদের উত্থান। জার্মানির গণতান্ত্রিক সমাজে ক্রমেই স্থান করে নিচ্ছেন কট্টরপন্থীরা।
জার্মানির ক্ষমতাসীন জোটের তিনটি দল—সামাজিক গণতান্ত্রিক দল, পরিবেশবাদী সবুজ দল এবং লিবারেল দল দুই রাজ্য পরিষদের নির্বাচনেই খারাপ করেছে। তবে একাবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে, ক্ষমতাসীন জোটের বড় দল, চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সামাজিক গণতান্ত্রিক দল। আর জার্মানির রাজনীতিতে ক্রমেই জায়গা করে নিচ্ছে কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড দলটি।
অথচ ২০২১ সালে জার্মানিতে ২০তম জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জার্মানির সবচেয়ে পুরোনো দল সামাজিক গণতান্ত্রিক দলটি বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় থাকার দুই বছর যেতেই দলটি ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, দুই বছরের মধ্যেই রাজনীতিতে এ দলের এমন পরিণতি কেন?
করোনাকালীন অর্থনীতি,রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধ, শরণার্থীদের নিয়ে বিতর্ক এবং পরিবেশ বাঁচাতে বিকল্প জ্বালানিসহ আরও কিছু বিষয়ে ক্ষমতাসীন জোটবদ্ধ তিন দলের রসায়ন মিলছে না। নেতৃত্ব ও সমন্বিত সিদ্ধান্তের অভাব ক্রমেই গতি হারাচ্ছে ক্ষমতাসীন জোট সরকার। হারাচ্ছে জনপ্রিয়তা।
জার্মানি সরকারের জ্বালানি নীতির ক্ষেত্রে নানা সিদ্ধান্তও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। পারমাণবিক শক্তি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার ঘোষণা, পাশাপাশি রাশিয়া–ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, শরণার্থী ও অভিবাসীদের নিয়ে বিতর্কে অনেক ভোটার জার্মানির কট্টরবাদী দলটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
আবার মূলধারার বড় দল সামাজিক গণতান্ত্রিক দল ও ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন বর্তমান সমাজ ও রাজনীতি ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক যুক্তি দিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। জার্মানির রাজনীতিতে তাদের এই দৈন্য ভোটারদের কট্টরবাদী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডমুখী করছে।
৮ অক্টোবর হেসেন ও ব্যাভেরিয়াতে দুই রাজ্য আইন পরিষদের নির্বাচনে প্রথমটিতে ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন দলটি সর্বোচ্চ ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে, সামাজিক গণতান্ত্রিক দলটি মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আর পরিবেশবাদী সবুজ দল পেয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট।
আর ব্যাভেরিয়া রাজ্যের নির্বাচনে রাজ্যভিত্তিক দল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন ৩৭ শতাংশ, ফ্রাই ভেলার দল ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ, পরিবেশবাদী সবুজ দল পেয়েছে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং সামাজিক গণতান্ত্রিক দলটি মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড বা জার্মানির জন্য বিকল্প দলটি জার্মানির ১৬টি রাজ্যের মধ্যে শ্লেসউইগ-হলস্টেইন এবং ব্রেমেন বাদে ১৪টি রাজ্য সংসদে স্থান করে নিয়েছে। জার্মানির আইনসভা বা বুন্ডেশটাগে এই দলের রয়েছে ৮৩টি আসন। একসময় ভাবা হতো, শুধু জার্মানির পূর্বাঞ্চলেই কট্টরবাদী দলটির জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু এখন তা ভুল প্রমাণ করে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে তাদের অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থন বাড়ছে।
ক্ষমতায় থেকে দুই বছর পার করলেও বর্তমান চ্যান্সেলর সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের ওলাফ শলৎজ তাঁর পূর্বসূরি আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে যেতে পারছেন না।
আঙ্গেলা ম্যার্কেল রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হয়েও দলের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দলের সমর্থক ভোটারদের কাছে ভোট আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। জার্মানিতে শলৎজ জোট সরকারের রাজনীতি উগ্রপন্থীদের উত্থান থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে।