তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সংবাদ প্রকাশ ও এসব ঘটনা নিয়ে মতামত দেওয়ায় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক আলোচকদের আটক করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর তদন্ত করা হচ্ছে। কোনো কোনো সাংবাদিককে হয়রানি এবং সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
ভূমিকম্পের সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মির আলী কোসের। ৬ ফেব্রুয়ারি আঘাত হানা এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় ২০০ মাইল দূরে ছিল তাঁর অবস্থান। কিন্তু তারপরও এ ভয়াবহ সংবাদ শুনে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে যান। সেখানকার পরিস্থিতি জানানোর পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেন।
উদ্ধারকারী ও ধ্বংসস্তূপের নিচে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প সংগ্রহ করে তিনি টুইটারে পোস্ট করে মানুষকে জানিয়েছেন। সাংবাদিক মির আলী কোসেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি ‘ভুয়া খবর’ ছড়িয়েছেন। এ ঘটনার তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে তাঁর।
৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে দুই দেশে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তুরস্কে ভূমিকম্প নিয়ে যাঁরা প্রতিবেদন বা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে—এমন অন্তত চার সাংবাদিকের মধ্যে মির আলী কোসের একজন। প্রেস ফ্রিডম গ্রুপগুলো বলছে, এ ঘটনায় আরও কয়েক ডজনকে আটক ও হয়রানি করা হয়েছে বা তাঁদের সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তবে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ আটকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
সাংবাদিক মির আলী কোসের কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর। তিনি বিয়ানেট ও দুভারের মতো বিরোধী পক্ষের গণমাধ্যমগুলোতে কাজ করেন। তিনি দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর দিয়ারবাকিরে থাকেন। ভূমিকম্পের রাতের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তীব্র কাঁপুনি অনুভব করেছি। ঘর কাঁপছে, টিভি কাঁপছে। পোষা দুই কুকুরের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়েছিলাম। এরপর বাইরে ছুটে যাই।’
এ ঘটনার কিছু সময় পর মির আলী দিয়ারবাকির ছেড়ে গাজিয়ানটেপ শহরে যান। সেখানে ধ্বংসস্তূপ দেখে হতবাক হয়েছিলেন। এ শহরে অন্তত তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মির আলী বলেন, ‘মাইক্রোফোন ধরে কথা বলার সময় আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।’
তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক ও উদ্ধারকারী দলের ঘটনা মির আলীকে বেশ স্পর্শ করেছিল। তিনি তাঁদের গল্প টুইটারে শেয়ার করেছিলেন। বেঁচে যাওয়া কয়েকজন তাঁকে বলেছেন, তাঁরা কয়েক দিন ধরে কোনো সাহায্য পাননি। বিরোধী পক্ষের গণমাধ্যমগুলোতেও একই অভিযোগ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি শহর পুনর্নির্মাণ করবেন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, যাঁরা ‘ভুয়া খবর’ ছড়ান এবং ‘সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন’, তাঁদের ‘উসকানিদাতা’ হিসেবে অভিহিত করে বিচার করা হবে।
মির আলী বলেছেন, তিনি যখন ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রকাশ করছিলেন, তখন দিয়ারবাকির পুলিশ তাঁর বাসায় একটি নোট রেখেছিল। সেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাঁকে থানায় গিয়ে একটি বিবৃতি দিতে হবে।
থানায় মির আলীকে বলা হয়েছিল, সম্প্রতি চালু হওয়া বিভ্রান্তিমূলক আইনের অধীন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে তথ্য প্রকাশের বিষয়ে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ করেছে।
গত অক্টোবরে তুরস্কে ভুয়া তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর রোধে নতুন আইন গৃহীত হয়েছে। এ আইনে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপ কাউন্সিলের আইনি নজরদারি সংস্থা ভেনিস কমিশন বলেছে, আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। আর বিরোধী দলগুলো এই আইনকে ‘সেন্সরশিপ আইন’ বলে অভিহিত করেছে।
মির আলী তাঁর কাজের ব্যাপারে খুব স্পষ্টবাদী ও সৎ ছিলেন। তিনি বিপর্যয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশ, উদ্ধারকর্মীসহ সব পক্ষের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা ও বিশ্লেষণ ছাড়া কোনো তথ্য শেয়ার করিনি।’
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) মির আলীর বিরুদ্ধে তদন্তকে ‘অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করে কর্তৃপক্ষকে তা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে।
অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) মতে, এমন অন্তত আরও তিনজন সাংবাদিক ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হচ্ছেন।
আরএসএফ বলছে, মেরদান ইয়ানারদা ও এনভার আইসেভার ইস্তাম্বুলভিত্তিক বিশিষ্ট রাজনৈতিক আলোচক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের বিপুলসংখ্যক অনুসারী আছেন। তাঁরা দুজনেই ভূমিকম্পে সরকারের উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। আর মেহমেত গুল নামের একজন মির আলীর মতোই দিয়ারবাকিরে থাকেন। এই তিনজনের বিষয়েই তদন্ত চলছে। সরকারের উদ্ধার প্রচেষ্টার সমালোচনাকারী একজন স্বেচ্ছাসেবকের সাক্ষাৎকার নেওয়ায় তাকে ‘বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার’ সন্দেহে মেহমেত গুলকে আটক করে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঠিক কতজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তা এখনো জানা যায়নি। গত মঙ্গলবার পুলিশ বলেছে, তাঁরা ‘উসকানিমূলক পোস্ট’ দেওয়ার জন্য ১৩৪ জনকে আটক করেছে। তাঁদের মধ্যে পরে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে আটক ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।
তবে সমালোচকেরা বলছেন, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর চেয়েও যেকোনো সমালোচনা শক্ত হাতে দমন করার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
ইস্তাম্বুল বিলগি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাইবার অধিকার বিশেষজ্ঞ ইয়ামান আকদেনিজ বলেন, ‘সরকার ভূমিকম্প অঞ্চল থেকে আসা তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিউনিকেশন ডিরেক্টর উদ্ধার অভিযান নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করার পর সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই দপ্তর এ নিয়ে স্মার্টফোনে অ্যাপও চালু করেছে, যা মানুষকে ভূমিকম্প সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর পোস্ট রিপোর্ট করতে উত্সাহিত করে।
ইস্তাম্বুলের এক সাংবাদিক আরজু গায়েবুল্লা বলেন, ‘যেকোনো সময় [তুর্কি] কর্মকর্তা ও সরকারের সমালোচনা করা হয়, তাঁরা এটা পছন্দ করেন না। তবে তাঁরা এবার সম্ভবত আরও সোচ্চার হয়েছেন।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্সিয়াল ডিরেক্টরেটের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে কোনো সাড়া পায়নি বিবিসি।